শল দাসগুপ্ত,শিলিগুড়ি: আর পাঁচটা মহিলার মতো যদি তানিয়া দত্ত সারাটা জীবন স্বামী-সন্তান নিয়ে কাটিয়ে দিতেন, কেউ হয়তো কিছু বলত না। শিলিগুড়ির প্রধাননগরের বাসিন্দা তানিয়ার জীবন শুরু হয়েছিল ঠিক সেভাবেই। তাঁর স্বামী বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করেন এবং কর্মসূত্রে থাকেন কলকাতায়। আর তানিয়া শিলিগুড়িতে সন্তানকে নিয়ে সংসার সামলাতেন। কিন্তু তানিয়া চাননি একটি গড়পড়তা জীবন। তাঁর ইচ্ছে ছিল নিজের পরিচয় তৈরি করার, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। সেই ইচ্ছেই তাঁকে এক নতুন পথে হাঁটতে অনুপ্রাণিত করল। গড়পড়তা জীবনের বাইরে নিজের আলাদা গল্প গড়ে তোলার সাহসটাই তানিয়াকে অনন্য করে তুলেছে।
কয়েক দিনের একটি প্রশিক্ষণ নিয়ে তানিয়া দত্ত বাড়িতে বসেই শুরু করেছিলেন বার্থডে কেক তৈরি। প্রথমে প্রতিবেশীদের জন্য কেক বানিয়ে তাঁদের খাওয়াতেন। যাঁরা কেক খেয়েছেন, প্রত্যেকেই প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কয়েক দিনের মধ্যেই তানিয়া বুঝে যান, তাঁর হাতে সত্যিই এক অসাধারণ জাদু রয়েছে। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পাকাপাকি ভাবে কেক ব্যবসায় নামলেন তানিয়া। তাঁর তৈরি কেক এখন এতটাই জনপ্রিয় যে শিলিগুড়ির প্রধাননগরের ‘ক্রিমি ক্রিয়েশন’ আজ রাজ্যের নামকরা কেক প্রস্তুতকারকদেরও টক্কর দিচ্ছে।
তানিয়া দত্তর কেক শুধু কোয়ালিটিতেই নয়, দামেও এক নতুন মাপকাঠি গড়ে তুলেছে। আগে শিলিগুড়িতে পাঁচশো টাকার নীচে বার্থডে কেক পাওয়ার কথা কেউ ভাবতেই পারত না। কিন্তু তানিয়ার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে এখন আড়াইশো থেকে তিনশো টাকাতেও ভালো মানের কেক পাওয়া যায়। তার পরেও, তানিয়ার ‘ক্রিমি ক্রিয়েশন’-এর জনপ্রিয়তা এতটাই যে প্রতিদিন দোকান থেকে গড়ে প্রায় দু’শো পাউন্ড বার্থডে কেক বিক্রি হয়। ভ্যানিলা, চকোলেট, ব্ল্যাক ফরেস্ট—যা চাইবেন, সবই আছে তানিয়ার সম্ভারে। আর উৎসবের মরশুমে কেকের উৎপাদন দ্বিগুণ হয়ে যায়! তানিয়ার কেকের খ্যাতি শিলিগুড়ির গণ্ডি পেরিয়ে এখন সিকিম, নেপাল, এমনকি ভুটান পর্যন্ত পৌঁছেছে। কেক কিনতে দূর-দূরান্ত থেকে ক্রেতারা ছুটে আসেন প্রধাননগরে।
আগে শিলিগুড়ির লোকেরা কেবলমাত্র জন্মদিনেই কেকের অর্ডার দিত, কিন্তু তানিয়া দত্তের হাতযশে এখন সেই দিনটি যেন আরেকটু বিশেষ হয়ে উঠেছে। এখন বিয়ের অনুষ্ঠানে, ব্যাঙ্ক কিংবা বেসরকারি হাসপাতালের অনুষ্ঠানে কেকের অর্ডারও চলে আসে। শুধু কেকই নয়, প্যাটিস, ক্রিম রোল, নানা রকম বেকারি সামগ্রীও তার দোকানে পাওয়া যায়। তানিয়ার দোকানের মাথায় একটি ছোট্ট ক্যাফেটোরিয়াও রয়েছে, যেখানে অতিথিরা খেতে-দিয়ে কিছুটা সময় কাটাতে পারেন। ২০১৮ সালে কেক তৈরি শুরু করেছিলেন তিনি, আর মাত্র ছয় বছরের মধ্যেই জীবনে এত ব্যস্ততা চলে আসবে, সেটা তানিয়া নিজেও ভাবতে পারেননি। তিনি বলেন, “আগে সময় কাটাতে চাইত না। বাচ্চা মানুষ করা ছাড়া তেমন কিছুই ছিল না। এখন তো দম ফেলার সময় নেই। ছেলেকে স্কুলে পাঠিয়ে সোজা ব্যবসার নানা কাজ শুরু হয়ে যায়।”
তানিয়ার ব্যবসার আয়তন শুধু কেকের পরিমাণ দিয়েই বোঝা সম্ভব নয়। সারাদিন ধরে বার্থডে কেক, অন্যান্য বেকারি সামগ্রী তৈরি করা, ক্যাফে পরিচালনা, এবং কারখানা সামলানোর কাজগুলো নিয়ে এখন তানিয়ার সঙ্গে যোগ দিয়েছেন চোদ্দজন কর্মচারী। এই মজবুত দল ছাড়া, তানিয়া একা কীভাবে এত বড় ব্যবসা পরিচালনা করতেন, তা কল্পনা করাও কঠিন। আরও চমকপ্রদ কথা হল, কোনও সরকারি বা ব্যাঙ্ক ঋণ ছাড়াই, প্রায় ৪২ লক্ষ টাকার মেশিনারি কিনে ফেলার শক্তি তিনি অর্জন করেছেন। ব্যবসার প্রথম দিকে, তানিয়ার স্বামী শিলিগুড়িতে ছুটিতে এসে, নিজের সাধ্যমতো তাকে সাহায্য করতেন। কেক ডেলিভারি দিতে নিজেই ছুটতেন, যেন কোনও সমস্যা না হয়।
দু’বছর হলো, স্ত্রী তানিয়াকে সাহায্য করতে স্বামী মৃত্যুঞ্জয় দত্ত চাকরি ছেড়ে শিলিগুড়িতে ফিরে এসেছেন। এখন তারা একসঙ্গে সারাদিন ব্যবসা সামলান। মৃত্যুঞ্জয় নিজে বলেন, “এই ব্যবসা গড়ে তোলার পিছনে আমার তেমন কোনও অবদান নেই। পুরো কৃতিত্বই আমার স্ত্রীর। আমি নেহাতই সাহায্যকারী। তবে মনে হয় একদিন আমরা অনেক উপরে যাব।”