ভারত-পাকিস্তান সংঘাত 2025: ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা যেন থামতেই চাইছে না। বৃহস্পতিবার দু’পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ তুলেছে। একই দিন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং সর্বদলীয় বৈঠক ডাকেন, যেখানে দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। ওই বৈঠকের পর কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কিরেন রিজিজু জানিয়েছেন, ‘অপারেশন সিন্দুর’ এখনো চালু রয়েছে এবং এটি একটি চলমান অভিযান।
এই টানটান পরিস্থিতিতে আশেপাশের প্রতিবেশী দেশগুলো কী অবস্থান নেবে, তা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই আগ্রহ বাড়ছে। বিবিসি এ নিয়ে কয়েকজন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকের সঙ্গে কথা বলেছে, যাতে বোঝা যায়—এই উত্তেজনার প্রভাব শুধু ভারত-পাকিস্তানেই সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়তে পারে গোটা অঞ্চলে।
‘মিডল ইস্ট ইনসাইটস’ নামের প্ল্যাটফর্মটির প্রতিষ্ঠাতা ড. শুভদা চৌধুরী বলেছেন, “ভারত ও পাকিস্তানের আশপাশের দেশগুলোয় আর্থ-সামাজিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা মানুষের সংখ্যাই বেশি। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে এতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এরকম মানুষের সংখ্যাটা খুব বড়।”
বাংলাদেশ, নেপাল, ভূটান, শ্রীলঙ্কার অবস্থান কী?
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান উত্তেজনা শুধু দুই দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়—এর বড় প্রভাব পড়তে পারে আশেপাশের প্রতিবেশী দেশগুলোর উপরও। আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মিয়ানমার ও ভুটানের মতো দেশগুলোর জন্য এই পরিস্থিতি নানা দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রসঙ্গ এখন আরও সংবেদনশীল। গত বছর জুলাই মাসে গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকে দেশটির নেতৃত্বে এসেছেন নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তবে এই সরকারের সঙ্গে ভারতের একাধিক বিষয়ে মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে, যার ফলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক কিছুটা টানাপোড়েনের মধ্যেই রয়েছে।
বিশ্লেষক কামার আগা মনে করেন, চীন যদিও বিভিন্ন দেশে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করেছে, তবে বাস্তবে দেখা গেছে—চীন নিজেই এই বিনিয়োগ থেকে বেশি লাভবান হয়েছে। এই অভিজ্ঞতা থেকেই মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশ আবার ভারতের দিকে ঝুঁকছে।
অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক শুভদা চৌধুরী জানাচ্ছেন, যদি ভারত-পাকিস্তানের এই সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে তা প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর একেকভাবে প্রভাব ফেলবে। যেমন, নেপালের ৬০ শতাংশ বাণিজ্যই ভারতের সঙ্গে, তাই উত্তেজনা বাড়লে নেপাল সরাসরি অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়বে। বন্দরের প্রবেশ, আমদানি-রপ্তানি এবং পর্যটন—সব কিছুতেই ধাক্কা লাগতে পারে।
শুভদার মতে, এই ফাঁকে চীন চেষ্টা করতে পারে নেপালের সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার করতে। একই অবস্থা হতে পারে ভুটানের ক্ষেত্রেও, কারণ ভারতের অর্থনীতি দুর্বল হলে তার প্রভাব সরাসরি ভুটানের পর্যটন ও অন্যান্য সেক্টরে পড়বে।
সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক ধনঞ্জয় ত্রিপাঠি মনে করেন, আফগানিস্তান ছাড়া বাকি প্রতিবেশী দেশগুলো এই ইস্যুতে বেশ নিরপেক্ষ এবং নীরব ভূমিকা পালন করবে। কারণ ভারতের সঙ্গে তাদের গভীর অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। বিশেষ করে নেপাল ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশের জন্য পর্যটন একটি বড় আয়ের উৎস, তাই তারা সংঘাতের দ্রুত অবসান চায়।
ভারত ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি রয়েছে এবং সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সংকটের সময় ভারত শ্রীলঙ্কাকে অনেক সহায়তা করেছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও শ্রীলঙ্কা সফরে গিয়েছিলেন।
ধনঞ্জয় ত্রিপাঠি মনে করেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার সময়ে এই দেশগুলো চাইবে যাতে আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত সমস্যার সমাধান করা হয়।
পররাষ্ট্র বিষয়ক বিশেষজ্ঞ কামার আগাও এর সঙ্গে একমত বলে মনে হচ্ছে। তিনি বলেন, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে।
কামার আগা বলেন, “সংঘাত বাড়লে অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে। কারণ যুদ্ধের সময় প্রতিরক্ষা ব্যয় বেড়ে যায় এবং তাতে কর্মসংস্থান হয় না। এদিকে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার পাকিস্তানের কিছুটা কাছাকাছি চলে এসেছে এবং তাদের বড় ক্ষতি হতে পারে। তবে বাংলাদেশে ভারতের বড়সড় বিনিয়োগ আছে।
চীনের অবস্থান
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান উত্তেজনার সময় চীনের অবস্থান ঘিরে আন্তর্জাতিক মহলের কৌতূহল বাড়ছে। কারণ, চীনের সঙ্গে যেমন পাকিস্তানের পুরনো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, তেমনি ভারতের সঙ্গেও তাদের গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক স্বার্থ জড়িয়ে আছে।
বর্তমানে চীন নিজেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি জটিল শুল্ক যুদ্ধের মধ্যে রয়েছে, যার ফলে চীনের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিও চাপের মুখে পড়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা যেন নতুন এক চিন্তার খোরাক।
চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্প্রতি ভারতের বিমান হামলা নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছে, তারা ঘটনাটি ‘দুঃখজনক’ বলে মনে করে। একইসঙ্গে মুখপাত্র বলেন, “ভারত ও পাকিস্তান একে অপরের প্রতিবেশী, এবং সবসময় তাই থাকবে। চীনও তাদের প্রতিবেশী। আমরা সব ধরনের সন্ত্রাসবাদের বিরোধিতা করি এবং চাই উভয় দেশ শান্তিপূর্ণ ও সংযত আচরণ করুক।”
চীনের পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানানো হলেও বিশ্লেষকরা বলছেন, এর পেছনে তাদের নিজেদের স্বার্থ জড়িত। কারণ পাকিস্তানে চীনের প্রায় ৬,৮০০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ রয়েছে, যার মধ্যে বড় অংশই এসেছে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (CPEC) ও বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI)-এর আওতায়। স্বাভাবিকভাবেই চীন চাইবে না, পাকিস্তান কোনোভাবে অস্থিতিশীল হোক এবং তাদের বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়ুক।
তবে পররাষ্ট্র বিষয়ক বিশ্লেষক কামার আগা এক ভিন্নমত পোষণ করে বলছেন, “চীনের কিছু সাম্প্রতিক বক্তব্য থেকে মনে হচ্ছে, তারা হয়তো চাইছে সংঘাত কিছুটা দীর্ঘস্থায়ী হোক। এতে একদিকে যেমন পাকিস্তানের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ বাড়বে, অন্যদিকে অস্ত্র বিক্রির মতো সুযোগও তৈরি হবে।
আফগানিস্তানের অবস্থান কী হবে?
ভারত-শাসিত কাশ্মীরের পহেলগামে ২২শে এপ্রিলের হামলার পর আফগানিস্তানের প্রতিক্রিয়া ছিল তাৎক্ষণিক এবং কড়া। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেছে, এ ধরনের ঘটনা শুধু নিরীহ মানুষের জীবন ঝুঁকির মুখে ফেলে না, বরং পুরো অঞ্চলজুড়ে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতাও হুমকির মুখে পড়ে।
‘অপারেশন সিন্দুর’-এর মাধ্যমে ভারতের সক্রিয় পদক্ষেপ এবং এর জেরে পাকিস্তানের সঙ্গে বাড়তে থাকা উত্তেজনা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আফগান সরকার। এক বিবৃতিতে আফগান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা চায় ভারত ও পাকিস্তান শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে এই সংকটের অবসান ঘটাক। সংঘাত নয়, বরং সংলাপই হোক সমাধানের পথ—এটাই আফগানিস্তানের বার্তা।
তবে এই অবস্থান যতই নিরপেক্ষ শোনাক না কেন, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘদিনের সীমান্ত বিরোধ বিষয়টিকে আরও জটিল করে তুলেছে। কামার আগা নামের এক বিশেষজ্ঞ বলছেন, “আফগানিস্তানের কোনো সরকারই পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের সীমান্ত—ডুরান্ড লাইনকে স্বীকৃতি দেয়নি। তাই দু’দেশের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে একটা অস্বস্তিকর সম্পর্ক রয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “ভারত-পাকিস্তান সংঘাত যদি আরও চরমে পৌঁছে যায়, তাহলে আফগানিস্তানকে ভারতের পাশে অবস্থান নিতে দেখা যেতে পারে।”
এই ডুরান্ড লাইন বিতর্কের শিকড় অনেক পুরনো। ১৮৯৩ সালে ব্রিটিশ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব স্যার মর্টিমার ডুরান্ড এবং আফগান রাজার মধ্যে হওয়া এক চুক্তির মাধ্যমে নির্ধারিত হয়েছিল এই সীমান্ত। পরে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান গঠিত হলে, সেই সীমান্ত চুক্তি নিয়েই প্রশ্ন তোলে আফগানিস্তান। তাদের দাবি, ওই চুক্তি এখনকার বাস্তবতায় আর বৈধ নয়।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক সঞ্জীব শ্রীবাস্তব এ বিষয়ে বলেন, “দক্ষিণ এশিয়ায় যেকোনো সংঘাতের প্রভাব সীমান্তের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। আফগানিস্তানের অবস্থানও সেই বিস্তৃত ভূ-রাজনৈতিক চিত্রের অংশ।