রান্না আর তেল – এই দুটো যেন একে অপরের পরিপূরক। প্রতিদিনের খাবারে কেউ সয়াবিন তেল ব্যবহার করেন, তো কেউ শর্ষের তেল। তবে বাঙালির রান্নাঘরের কথা উঠলেই শর্ষের তেলের সেই ঝাঁঝালো ঘ্রাণ যেন চোখ বন্ধ করলেই মনে পড়ে যায়। এখন আবার অনেকেই সয়াবিনের বদলে ধীরে ধীরে শর্ষের তেলের দিকেই ঝুঁকছেন। কারণটা বেশ সহজ – একদিকে সয়াবিন তেলের দাম হু হু করে বেড়েই চলেছে, আর অন্যদিকে শোনা যাচ্ছে এই তেল নাকি শরীরের জন্য ততটাও উপকারী নয়।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, শর্ষের তেল কি আদৌ শরীরের পক্ষে ভালো? কেউ বলেন এতে অনেক উপকার, আবার কেউ মনে করেন এতে লুকিয়ে আছে নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি। শর্ষের তেলে ভাজা মাছ কিংবা বেগুন খাবার আগে জেনে নেওয়া যাক- এই তেল স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নাকি খারাপ।
শর্ষের তেলে রান্না: স্বাস্থ্যের জন্য ভালো না খারাপ?
পুষ্টির প্রয়োজনে
পুষ্টিবিদদের মতে, শর্ষের তেল শুধু রান্নার স্বাদই বাড়ায় না, বরং স্বাস্থ্যের দিক থেকেও এর বেশ কিছু ইতিবাচক দিক আছে। এই তেলে রয়েছে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড—একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যা আমাদের শরীর নিজে থেকে তৈরি করতে পারে না। তাই খাবারের মাধ্যমেই সেটা গ্রহণ করা জরুরি।
অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন, শর্ষের তেল অন্যান্য রান্নার তেলের তুলনায় অনেকটাই স্বাস্থ্যকর। এর অন্যতম কারণ, এতে সম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড (saturated fat) কম পরিমাণে থাকে। এই ধরনের ফ্যাটই মূলত রক্তে খারাপ চর্বি বা এলডিএল (LDL) বাড়িয়ে দেয়, যা হৃদরোগের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
তবে যেকোনো জিনিসের মতোই, পরিমিত বোধ বজায় রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ। মাঝেমধ্যে শর্ষের তেলে রান্না করা খাবার খেলে একজন সুস্থ মানুষের শরীরে খারাপ চর্বির পরিমাণ বাড়ে না—বরং ঠিকভাবে খেলে এটি দেহের জন্য বেশ উপকারী হতে পারে।
শর্ষের তেলে আরও আছে ভিটামিন ই
শর্ষের তেলে রয়েছে ভিটামিন ই, যা এক শক্তিশালী অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। এই উপাদান দেহের কোষগুলোকে রক্ষা করতে সাহায্য করে, বিশেষ করে ফ্রি র্যাডিক্যালের মতো ক্ষতিকর উপাদানের হাত থেকে।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের শরীরে নানা ধরনের পরিবর্তন আসে—যার একটা বড় প্রভাব পড়ে ত্বকের উপরেও। অনেকের ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ত্বকে বয়সের ছাপ পড়ে যায় অনেক আগেই।
জ্বরের সময়ে খাবেন না এই খাবারগুলো – জানুন কেন!
কিন্তু গবেষণা বলছে, নিয়মিত অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট শরীরে পৌঁছালে এই প্রক্রিয়া অনেকটাই ধীর হয়। অর্থাৎ, ত্বকে বয়সের ছাপ পড়ার গতি কমে যায়, আর তারুণ্যের ছাপ কিছুটা হলেও দীর্ঘস্থায়ী হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শর্ষের তেল ব্যবহার করলে এই উপকার মিলতে পারে। তাই শুধু রান্নার স্বাদ নয়, স্বাস্থ্য আর ত্বকের যত্নেও শর্ষের তেল হতে পারে আপনার ভরসার এক ঘরোয়া উপায়।
শর্ষের তেলের স্বাদ, ঝাঁজ আর ঘ্রাণ- সবই একেবারে আলাদা। গরমের সময় অনেকেই খাবারে অরুচি অনুভব করেন। এমন সময় সামান্য শর্ষের তেল মিশিয়ে ভর্তা কিংবা শর্ষের তেলের তৈরি আচার খেলে মুখের রুচি ফেরে। স্বাদে আসে ভিন্নতা, আর খাওয়ার পর কিছুটা আরামও মেলে।
শর্ষের তেল উপকারী
শর্ষের তেল যে উপকারী, সেটা আমরা অনেকেই জানি। কিন্তু উপকারের পাশাপাশি এর কিছু দিক নিয়ে সতর্ক থাকা খুব জরুরি—কারণ সব ভালো জিনিসও মাত্রা ছাড়ালে সমস্যা ডেকে আনতে পারে।
১. শর্ষের তেলে থাকে ইউরোসিক অ্যাসিড। এই উপাদান বেশি পরিমাণে এবং নিয়মিত শরীরে গেলে হৃদ্রোগের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে কিডনিতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনাও তৈরি হয়।
২. ইউরোসিক অ্যাসিড আবার শরীরে ইউরিক অ্যাসিডের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে পারে, যার ফলে বাতের ব্যথার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাছাড়া, শর্ষের তেলে যে পরিমাণ সম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে, তা দীর্ঘদিন অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া হলে রক্তে খারাপ চর্বির (LDL) মাত্রা বাড়াতে পারে।
৩. বিশেষ করে যারা আগে থেকেই হৃদ্রোগে আক্রান্ত, তাদের ক্ষেত্রে শর্ষের তেল একটানা এবং নিয়মবিহীনভাবে ব্যবহার না করাই ভালো।
৪. আর একটা বড় সতর্কতা – তেল যদি খাঁটি না হয় বা যদি তাতে ক্ষতিকর রাসায়নিক মেশানো থাকে, তাহলে সেটা শরীরের জন্য আরও ক্ষতিকর হতে পারে। বাজারে অনেক সময় সস্তার লোভে নকল বা ভেজাল তেল বিক্রি হয়, যেগুলো খেলে উপকারের বদলে শরীরের ক্ষতিই হয় বেশি।
৫. আর একটা ব্যাপার মাথায় রাখা দরকার – শুধু শর্ষের তেল নয়, যেকোনো তেলেই ডুবোতেলে ভাজা খাবার স্বাস্থ্যকর নয়। এইভাবে রান্না করলে শর্ষের তেলের স্বাদ-ঘ্রাণ যেমন নষ্ট হয়ে যায়, তেমনি একটা অদ্ভুত গন্ধও তৈরি হয়, যা অনেকেই সহ্য করতে পারেন না।
সুতরাং, শর্ষের তেল উপকারী – এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে সেটা কতটা, কীভাবে, আর কোন মানের তেল ব্যবহার করছেন – সেটাও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। পরিমিত ব্যবহার, খাঁটি তেল, আর স্বাস্থ্যবান্ধব রান্নার পদ্ধতি – এই তিনটাকে মাথায় রাখলে শরীরও ভালো থাকবে, আর মনও তৃপ্ত হবে পাতে শর্ষের ঘ্রাণ পেলে।