ক্যানসারের লক্ষণ: ক্যানসার বা কর্কটরোগ—এই শব্দটা শুনলেই আমাদের মনে একটা ভয় কাজ করে, কারণ এটি এমন এক রোগ, যা শরীরে কোষের অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়ে ওঠার ফলে তৈরি হয়। এখনো পর্যন্ত এই রোগটি বহু মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে, তাই ভয় পাওয়াটাও স্বাভাবিক।
তবে আশার কথা হল, চিকিৎসা বিজ্ঞানে যতই অগ্রগতি হচ্ছে, ততই এই রোগে আক্রান্তদের বেঁচে থাকার হার বাড়ছে। আর এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হলো, সময়মতো রোগ ধরা পড়া এবং তাড়াতাড়ি চিকিৎসা শুরু করা।
আমরা অনেকেই ভাবি, ক্যানসার মানেই মৃত্যু। কিন্তু বাস্তবটা তা নয়। বেশিরভাগ ক্যানসারই সময়মতো ধরা পড়লে চিকিৎসার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, এমনকি পুরোপুরি সেরে যাওয়ারও সম্ভাবনা থাকে। যেসব মানুষ মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছানোর আগেই চিকিৎসা শুরু করতে পারেন, তাঁদের অনেকেই সুস্থ জীবন ফিরে পান।
তবে সমস্যা হয় তখনই, যখন আমরা শরীরে কিছু অদ্ভুত পরিবর্তন বা ছোটখাট উপসর্গকে গুরুত্ব না দিয়ে এড়িয়ে চলি। অনেক সময় গলায় সামান্য ব্যথা, অস্বাভাবিক রক্তপাত, হঠাৎ ওজন কমে যাওয়া বা দীর্ঘদিন ধরে কাশি – এমন লক্ষণগুলোকে আমরা তেমন গুরুত্ব দিই না। অথচ এগুলোই হতে পারে ক্যানসারের প্রাথমিক সতর্ক সংকেত।
যুক্তরাজ্যের ক্যানসার গবেষণা সংস্থার এক গবেষণায় দেখা গেছে, যুক্তরাজ্যের অর্ধেকের বেশি বাসিন্দা জীবনের কোনো না কোন সময়ে এমন কোনো উপসর্গে ভুগেছেন যেটি আসলে ক্যানসারের উপস্থিতি জানান দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু মাত্র ২ শতাংশ মনে করেছেন যে এর কারণে তাদের ভুগতে হতে পারে এবং এক তৃতীয়াংশের বেশি মানুষ একে কোনো ধরনের পাত্তাই দেননি এবং এর ফলে চিকিৎসকের কাছেও যাননি।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের গবেষক এবং এই ক্যানসার গবেষণার প্রধান, ক্যাটরিনা হুইটেকার এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, অনেক মানুষ এমনও আছেন যারা শরীরে কোনো সমস্যার লক্ষণ থাকা সত্ত্বেও চিকিৎসকের কাছে যেতে সংকোচ বোধ করেন। তাঁদের মনে হয়, এমন ছোটখাটো সমস্যার জন্য চিকিৎসকের সময় নষ্ট করা বা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর চাপ তৈরি করা ভুল হবে।
কিন্তু এমন ভাবনা আমাদের অনেক সময় বড় বিপদের দিকে ঠেলে দিতে পারে। হুইটেকার বলেন, আমাদের এটা বোঝাতে হবে যে—যদি কারও শরীরে এমন কোনও উপসর্গ দেখা দেয়, যেটা সহজে যাচ্ছে না, বিশেষ করে যেগুলো ক্যানসারের সম্ভাব্য সতর্ক সংকেত হতে পারে, তাহলে সেটিকে অবহেলা করা একেবারেই ঠিক নয়। বরং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটি মনে করে, ক্যানসারের ১০টি সাধারণ উপসর্গের বিষয়ে অবহেলা করা উচিত নয়। চলুন বিবিসির প্রতিবেদন থেকে জেনে নেওয়া যাক ক্যানসার ১০টি উপসর্গ।
কোনো কারণ ছাড়া ওজন কমে যাওয়া
অনেক সময় দেখা যায়, ক্যানসারে আক্রান্ত ব্যক্তিরা ধীরে ধীরে ওজন হারাতে থাকেন—তাও আবার কোনো স্পষ্ট কারণ ছাড়াই। এই অজানা ওজন কমে যাওয়াকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে বলা হয় “ব্যাখ্যাহীন ওজন হ্রাস”। ব্যাপারটা কিন্তু হালকাভাবে নেওয়ার মতো নয়। হঠাৎ করে, কোনো ডায়েট না মেনে বা শরীরচর্চা না করেও যদি কারও ওজন পাঁচ কেজি বা তার বেশি কমে যায়, তাহলে সেটি ক্যানসারের প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে। বিশেষ করে অগ্ন্যাশয় (প্যানক্রিয়াস), পাকস্থলি (স্টমাক), খাদ্যনালি (ইসোফাগাস) বা ফুসফুসের ক্যানসারে এই রকম ওজন কমে যাওয়ার ঘটনা বেশি দেখা যায়।
জ্বর
ক্যানসার আক্রান্ত রোগীদের সবচেয়ে সাধারণ একটি উপসর্গ হচ্ছে জ্বর। অবশ্য যে স্থানে ক্যানসার উৎপন্ন হয়েছে সেখান থেকে দেহের অন্য স্থানে ছড়িয়ে পড়া শুরু হলে তখন প্রায়ই জ্বর দেখা দেয়। অনেক ক্ষেত্রে জ্বর ক্যানসারের প্রাথমিক উপসর্গও হতে পারে। যেমন লিউকেমিয়া বা লিম্ফোমা।
ক্লান্তি
ক্লান্তি বোঝানো হয়েছে চরম ক্লান্তিভাব যা বিশ্রাম নেওয়ার পরও কমে না। ক্যানসার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপসর্গ হিসেবে দেখা দিতে পারে। কিছু কিছু ক্যাসনার যেমন লিউকেমিয়ার ক্ষেত্রে শুরুর দিকেই ক্লান্তি দেখা দিতে পারে।
কিছু কোলন বা মলাশয় ও পাকস্থলির ক্যানসারের ক্ষেত্রে রক্তপাত হতে পারে, তবে সেটা সবার ক্ষেত্রে হয় না। এর কারণেও ক্যানসারের সময় ক্লান্তি দেখা দিতে পারে।
ত্বকে পরিবর্তন
ত্বকের ক্যানসার ছাড়াও আরও কিছু ক্যানসার রয়েছে যাতে আক্রান্ত হলে ত্বকের পরিবর্তন দেখা দেয়। এর লক্ষণ ও উপসর্গের মধ্যে রয়েছে, ত্বক কালো হয়ে যাওয়া বা হাইপারপিগমেনটেশন ত্বক ও চোখ হলুদ হয়ে যাওয়া বা জন্ডিস ত্বক লাল হয়ে যাওয়া। চুলকানি, মাত্রাতিরিক্ত চুলের বৃদ্ধি।
অন্ত্রের ক্রিয়া বা মূত্রাশয়ের কার্যক্রমে পরিবর্তন
কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়রিয়া বা মলের আকারে দীর্ঘদিন ধরে পরিবর্তন আসা হলে সেটা মলাশয়ের ক্যানসারের একটি সতর্কবার্তা হতে পারে। আর যদি প্রস্রাব করার সময় ব্যথা হয়, রক্ত দেখায়, অথবা প্রস্রাবের পরিমাণে অস্বাভাবিক কিছু বদল দেখা দেয় — যেমন আগের থেকে বেশি বা কম প্রস্রাব হওয়া — তখন সেটাও মূত্রাশয় বা প্রোস্টেট ক্যানসারের লক্ষণ হতে পারে। এসব লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া খুবই জরুরি।
যে ক্ষত ভালো হয় না
অনেকেই জানেন, দেহে যদি কোনো আঁচিল বা দাগ থাকে যা সময়ের সাথে বড় হয়, ব্যথা দেয় বা সেটি থেকে রক্তপাত হয়, তাহলে সেটা ত্বকের ক্যানসারের একটা ইঙ্গিত হতে পারে। কিন্তু শুধু তাই নয়, শরীরে এমন কোনো ক্ষত বা ঘা থাকলেও যেটা চার সপ্তাহের বেশি সময় পর্যন্ত ভালো হয় না বা সেরে ওঠে না, সেটা অবশ্যই নজরে রাখা উচিত। মুখে যদি এরকম কোনো ক্ষত দেখা দেয়, তাহলে সেটা মুখের ক্যানসারের লক্ষণ হতে পারে। তাই এসব ব্যাপারে যত দ্রুত সম্ভব ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া খুব জরুরি।
শরীরের যেকোনো স্থান শক্ত হয়ে যাওয়া
অনেক ধরনের ক্যানসারই শরীরের ত্বকের মাধ্যমে চেনা যায়। বিশেষ করে স্তন, অণ্ডকোষ, গ্রন্থি বা শরীরের নরম টিস্যুতে এই ধরনের ক্যানসার বেশি দেখা যায়। এমন ক্ষেত্রে দেহে কোথাও একটা শক্ত বা মাংসের মতো জমাটবদ্ধ কিছু অনুভব হতে পারে। এটা প্রাথমিক বা কখনো কখনো একটু দেরিতে দেখা দেয় এমন ক্যানসারের লক্ষণ হতে পারে। তাই শরীরে এমন কোনো অস্বাভাবিক পরিবর্তন হলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
রক্তপাত
ক্যানসারের ক্ষেত্রে প্রাথমিক অবস্থায় কিংবা তা ছড়িয়ে পড়ার পর অস্বাভাবিক রক্তপাত হতে পারে। কাশির সঙ্গে রক্তপাত ফুসফুসের ক্যানসারের লক্ষণ হতে পারে। অন্যদিকে যদি মলের সঙ্গে রক্তপাত হয় তাহলে এটি মলাশয় বা মলদ্বারে ক্যানসারের লক্ষণ হতে পারে।
টানা কাশি বা কণ্ঠস্বরে পরিবর্তন
টানা কাশি ফুসফুসের ক্যানসারের লক্ষণ হতে পারে। তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে কাশি থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। এ ছাড়া কণ্ঠস্বরে পরিবর্তন এলে তা স্বরযন্ত্র বা থাইরয়েড গ্রন্থিতে ক্যান্সারের উপস্থিতি নির্দেশ করতে পারে।
গিলতে অসুবিধা
যদি আপনি অনেক দিন ধরে বদহজমের সমস্যায় ভুগছেন বা খাবার গিলতে কষ্ট হয়, তাহলে সেটা ইসোফ্যাগাস, পাকস্থলী বা গলার ক্যানসারের লক্ষণ হতে পারে। তবে মনে রাখবেন, এই সব উপসর্গ ক্যানসারের পাশাপাশি অন্য অনেক স্বাভাবিক বা চিকিৎসাযোগ্য সমস্যার থেকেও হতে পারে। তাই কোনো সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হলে দেরি না করে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করাই সবচেয়ে ভালো।
গুরুত্বপূর্ণ খবরের জন্য | Join Group |
চাকরির খবরের জন্য | Join JKNEWS24 Jobs |
রাশিফলের জন্য | Join NEWS24 |
খেলার খবরের জন্য | Join Whatsapp |