প্রথাগত সংগীত শিক্ষা না থাকা সত্ত্বেও যিনি বলিউডে নিজের স্বতন্ত্র জায়গা তৈরি করেছিলেন, তিনি আর কেউ নন— কিংবদন্তি কিশোর কুমার (Kishore Kumar)। একাধারে গায়ক, অভিনেতা, সংগীত পরিচালক, প্রযোজক, পরিচালক, লেখক ও কৌতুকাভিনেতা— এই এক মানুষই যেন পুরো এক বিনোদন জগতের সমান। তাঁর কণ্ঠের জাদু, অভিনয়ের সহজাত মাধুর্য আর অগাধ সৃজনশীলতা আজও দর্শক-শ্রোতাদের মুগ্ধ করে রাখে।
খণ্ডোয়া থেকে মুম্বই: এক যাত্রার শুরু
১৯২৯ সালের ৪ অগস্ট, মধ্যপ্রদেশের খণ্ডোয়ায় জন্ম কিশোর কুমারের। তাঁর আসল নাম ছিল আভাস কুমার গঙ্গোপাধ্যায়। বাবা কুঞ্জলাল ছিলেন পেশায় আইনজীবী, মা গৌরীদেবী গৃহিণী। তিন দাদার মধ্যে বড় অশোক কুমার তখনই হিন্দি ছবির জনপ্রিয় নায়ক। তাঁর অনুপ্রেরণাতেই ছোট ভাই আভাস মুম্বইয়ের বম্বে টকিজে যোগ দেন— প্রথমে কোরাস গায়ক হিসেবে। এখান থেকেই শুরু হয় এক কিংবদন্তির গল্প। দাদা অশোক কুমারের হাত ধরেই কিশোরের প্রথম অভিনয়— ১৯৪৬ সালের ‘শিকারি’ ছবিতে। ১৯৪৮ সালে ‘জিদ্দি’-তে প্রথম প্লেব্যাক করেন। কিন্তু শুরুটা খুব সহজ ছিল না— প্রথম দিকের বেশিরভাগ ছবিই বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ে। তবু তিনি থামেননি।
গানের প্রতি তাঁর প্রেমই তাঁকে আলাদা করে তোলে। তাঁর প্রিয় শিল্পী ছিলেন কে এল সায়গল ও আহমেদ রুশদি। এস. ডি. বর্মনের এক উপদেশ তাঁর জীবন বদলে দেয়— ‘নিজের কণ্ঠে গান করো।’ সেই থেকেই জন্ম নেয় কিশোরের স্বকীয় স্টাইল— ইয়োডলিং। পাশ্চাত্য প্রভাব মিশে যায় ভারতীয় সুরে। রূপ তেরা মস্তানা’, ‘জিন্দেগি এক সাফর’, ‘পল পল দিল কে পাস’, ‘মেরে সপনো কি রানি’— প্রতিটি গানেই যেন এক নতুন জাদু।
রাজেশ খন্না থেকে অমিতাভ বচ্চন— কিশোর কুমারের কণ্ঠ যেন তাঁদের পর্দার আত্মা হয়ে উঠেছিল। ‘আরাধনা’, ‘আমার প্রেম’, ‘দন’, ‘আনন্দ’— প্রতিটি ছবির সাফল্যের নেপথ্যে তাঁর সুরেলা কণ্ঠ এক অমোঘ জাদু ছড়িয়েছে। ১৯৭৫-৭৭ সালের জরুরি অবস্থার সময় সরকার-নির্দেশিত প্রচারে অংশ নিতে তিনি দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেন, যার ফলস্বরূপ তাঁর গান নিষিদ্ধ হয় অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো ও দূরদর্শনে। তবুও তিনি আপস করেননি। খামখেয়ালি, স্বাধীনচেতা কিশোর কুমার নিজের বিশ্বাসে অটল ছিলেন— ঠিক যেমন ছিলেন তাঁর সঙ্গীত, অকৃত্রিম ও অনন্য।
সব খবর
রুমা গুহঠাকুরতা থেকে মধুবালা, যোগিতা বালি থেকে লীনা চন্দভরকর— কিশোর কুমারের জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ই প্রেম, আবেগ আর ঝড়ো অভিজ্ঞতায় ভরা। মধুবালার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল একদিকে স্বপ্নময় রোম্যান্স, অন্যদিকে গভীর বেদনার গল্প। জীবনের শেষ পর্বে লীনা চন্দভরকরের সঙ্গে কিছুটা শান্তি খুঁজে পেলেও, তাঁর ভেতরের নিঃসঙ্গ মানুষটি যেন কখনও পুরোপুরি মুক্তি পায়নি। আলো-আঁধারের সেই মিশ্রণই তাঁকে করে তুলেছিল আরও মানবিক, আরও রহস্যময়— এক চিরকালীন কিংবদন্তি।
১৩ অক্টোবর, ১৯৮৭। সকালে হালকা অস্বস্তি বোধ করছিলেন কিশোর। লীনা ডাক্তার ডাকতে চাইলে হাসতে হাসতেই বলেছিলেন, ‘তুমি যদি ডাক্তার ডাকো, আমার কিন্তু হার্ট অ্যাটাক হবে!’ কয়েক মিনিট পরেই সত্যি হয়ে যায় তাঁর কথা— হার্ট অ্যাটাকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সুরের এই জাদুকর। আজ তাঁর প্রয়াণের তিন দশকেরও বেশি সময় কেটে গেছে। কিন্তু তাঁর গান, হাসি, পাগলামি— সবই আজও নতুন প্রজন্মের কাছে প্রেরণা। তিনি একাই প্রমাণ করেছিলেন— প্রতিভা কখনও নিয়মে বাঁধা থাকে না। তাই কিশোর কুমার আজও শুধু এক নাম নয়, এক অনুভূতি।


