জাতির জনক মহাত্মা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ১৮৬৯ সালের ২ অক্টোবর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের কাথিয়াবাড় প্রদেশের পোরবন্দর নামক স্থানে এক সাধারণ বণিক হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন (Mahatma Gandhi Biography In Bengali)। তাঁর পিতা করমচাঁদ উত্তরচাঁদ গান্ধী ছিলেন এক প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রনেতা, আর মাতা পূত্তলিবাই ছিলেন গভীর ধর্মবিশ্বাসী ও নীতিবান মহিলা। ছোটবেলা থেকেই গান্ধীজির জীবনে পরিবারের ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের প্রভাব ছিল প্রবল। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি সমবয়সী কস্তুরবা সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, পরবর্তীতে তাঁদের চারটি সন্তান জন্ম নেয়।
| নাম | মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী |
| জন্ম | ২রা অক্টোবর ১৮৬৯ |
| জন্মস্থান | পোরবন্দর, গুজরাট, ব্রিটিশ ভারত |
| অন্যান্য নাম | মহাত্মা গান্ধী, বাপুজি, গান্ধীজি |
| মৃত্যু | ৩০শে জানুয়ারি ১৯৪৮ |
মহাত্মা গান্ধীর শিক্ষা জীবন (Mahatma Gandhi Biography In Bengali)
শৈশব থেকেই গান্ধীজি পিতার কাছ থেকে সত্য ও সাহসের শিক্ষা, আর মাতার কাছ থেকে পেয়েছিলেন ধর্মনিষ্ঠা ও ব্রত পালনের অনুশাসন। ছোটবেলা থেকেই তাঁর জীবনে নৈতিকতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের গভীর প্রভাব পড়েছিল। কাথিয়াবাড়ে প্রাথমিক ও বাল্য শিক্ষা সম্পন্ন করে তিনি ১৮ বছর বয়সে ম্যাট্রিক পাশ করেন। পরবর্তীতে বড় ভাইয়ের উৎসাহে ব্যারিস্টারি পড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং পরিবারকে বিদায় জানিয়ে ১৮৮৮ সালে পাড়ি জমান বিলাতে। সেখানকার কঠোর পরিশ্রম ও নিষ্ঠার মাধ্যমে ১৮৯১ সালে ব্যারিস্টারি পাশ করে তিনি ভারতে ফিরে আসেন।
মহাত্মা গান্ধীর কর্ম জীবন
বিলেতে ব্যারিস্টারি সম্পন্ন করার পর গান্ধীজি আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি আব্দুল্লা এন্ড সন্স সংস্থার আইনজীবি হিসাবে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যান, যা তাঁর জীবনে এক নাটকীয় পরিবর্তন আনে। সেখানে তিনি ভারতীয় এবং কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বৈষম্যের মুখোমুখি হন, যা তাঁকে ভারতীয়দের অধিকার সচেতন করার দিকে প্রেরণা দেয়। ১৮৯৪ সালে তিনি নাটাল ইন্ডিয়ান কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন এবং স্থানীয় ভারতীয়দের রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করে কৃষ্ণাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। এরপর ১৯১৫ সালের ৯ জানুয়ারি ভারতবর্ষে প্রত্যাবর্তন করে তিনি সক্রিয়ভাবে দেশীয় রাজনীতিতে যোগ দেন।
চম্পারন ও খেদা সত্যাগ্রহ আন্দোলন
১৯১৮ সালের চম্পারণ বিক্ষোভ এবং খেদা সত্যাগ্রহ আন্দোলনের মাধ্যমে গান্ধীজি ব্রিটিশ সরকারের প্রভাবাধীন জমিদারদের দ্বারা কৃষক সমাজের প্রতি চলমান বর্বরোচিত অত্যাচার ও অতিরিক্ত খাজনা আদায়ের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে আন্দোলন শুরু করেন। এই আন্দোলনে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের সহযোগিতা নেন এবং ফলস্বরূপ কৃষকদের উপরে চাপানো খাজনা আদায় বন্ধ হয় এবং আটককৃত কৃষকদের মুক্তি প্রদান করা হয়।
সব খবর
অসহযোগ আন্দোলন
গান্ধীজির মতে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র হলো অসহযোগ এবং শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধ। পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডে ভারতীয়দের ওপর বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়ে তিনি ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভের আহ্বান জানান। স্বরাজের দাবিতে ১৯২১ সালে গান্ধীজি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নির্বাহী পদে নিযুক্ত হন এবং খাদি ও চরকিতে সুতা কাটার মাধ্যমে বিদেশী পণ্য বর্জন ও স্বদেশী পণ্য গ্রহণের আহ্বান জানান। এই সময় অসহযোগ আন্দোলন ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও সাফল্য অর্জন করে, কিন্তু উত্তরপ্রদেশের চৌরিচৌরাতে হঠাৎ সংঘর্ষ বাঁধার কারণে আন্দোলনটি শেষ হয়।
স্বরাজ ও লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন
বিংশ শতাব্দীর ২০-এর দশকে গান্ধীজি নিজেকে নীরব রেখে স্বরাজ পার্টি ও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে সমন্বয় স্থাপনের চেষ্টা করেন। ১৯২৮ সালের ডিসেম্বরে তিনি ব্রিটিশ সরকারের প্রতি ভারতকে ডোমিনিয়নের মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানান এবং পূর্ণ স্বাধীনতার লক্ষ্যে সরাসরি হুমকি প্রদান করেন। ১৯২৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর জাতীয় পতাকা উন্মোচন এবং ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এই দিনটিকে প্রথম স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন করে।
এ সময় ব্রিটিশ সরকারের অত্যাবশ্যকীয় পণ্য লবণের উপর কর আরোপের বিরুদ্ধে লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন। আত্মনির্ভরতার চেতনায় নিজ হাতে লবণ তৈরি করার উদ্দেশ্যে তিনি এলাহাবাদ থেকে ডান্ডি পর্যন্ত প্রায় ৪০০ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে যান। আন্দোলনটি ব্যাপক সাফল্য অর্জন করলে ব্রিটিশ সরকার ৬০,০০০ ভারতীয়কে গ্রেফতার করে। ১৯৪১ সালে গান্ধীজি ডারউইন অ্যাক্টের মাধ্যমে অসহযোগ আন্দোলন স্থগিত করে বন্দীদের মুক্তি নিশ্চিত করেন এবং স্বাধীনতার পথে এক গুরুত্বপূর্ণ সুপ্রস্তুত ভিত্তি স্থাপন করেন।
গান্ধীজির শিক্ষানীতি
গান্ধীজির মূল লক্ষ্য ছিল সত্যের পথে শিক্ষাকে সকলের জন্য, বিনামূল্যে এবং সর্বসাধারণের জন্য প্রতিষ্ঠিত করা। তিনি বিশেষভাবে শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার প্রবক্তা ছিলেন এবং শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের চরিত্র ও নৈতিক বিকাশে বিশ্বাসী ছিলেন। ভারতবর্ষের বুনিয়াদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠাতারূপে তাঁর অবদান আজও অমর কৃতি হিসেবে স্মরণীয়।
সম্মাননা
স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং আধ্যাত্মিক চেতনার অধিকারী মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর খ্যাতি শুধু ভারতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না; সমগ্র বিশ্বজুড়ে তিনি মহাত্মা গান্ধী নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি সমগ্র ভারতবাসীর জাতির জনক হিসেবে সম্মানিত, তাই ভারত সরকার প্রতি বছর ২রা অক্টোবর তাঁর জন্মদিনে গান্ধী জয়ন্তী উদযাপন করে। ২০০৭ সালে ১৫ই জুন জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিনকে আন্তর্জাতিক অহিংসা দিবস হিসেবে ঘোষিত করা হয়। এছাড়াও, ভারতীয় সংসদ ভবনে গান্ধীজির প্রতিমূর্তিও স্থাপন করা হয়েছে।
জীবনাবসান
স্বাধীনতার প্রতি কঠোর সংগ্রাম করা গান্ধীজি মহাশয় পাননি স্বাধীনতার চরমস্বাদ। বরং ১৯৪৮ সালে ৩০শে জানুয়ারী দিল্লীতে অনুষ্ঠিত এক প্রার্থনা সভায় নাথুরাম গডসের করা গুলিতে নিহত হন।
গান্ধীজীর লেখা দুটি বইয়ের নাম কি?
গান্ধীজীর লেখা দুটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো তাঁর আত্মজীবনী ‘সত্যের সাথে আমার পরীক্ষা’ (The Story of My Experiments with Truth) এবং রাজনৈতিক প্রবন্ধ ‘হিন্দ স্বরাজ’ (Hind Swaraj)। ‘সত্যের সাথে আমার পরীক্ষা’-এ গান্ধীজি তাঁর জন্ম থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা, নৈতিক শিক্ষা এবং আত্ম-অনুসন্ধানের গল্প তুলে ধরেছেন। এটি মূলত ১৯২৫ থেকে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত সাপ্তাহিক কিস্তিতে প্রকাশিত হয়েছিল। অন্যদিকে, ১৯০৯ সালে লেখা ‘হিন্দ স্বরাজ’-এ তিনি ব্রিটিশ শাসন, আধুনিক সভ্যতার সমালোচনা এবং ভারতের জন্য স্বরাজ প্রতিষ্ঠার রূপরেখা উপস্থাপন করেছেন। এই দুটি গ্রন্থই গান্ধীজীর দর্শন, নৈতিকতা ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
মহাত্মা গান্ধীর স্ত্রীর নাম কী ছিল?
১৮৮৩ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে মহাত্মা গান্ধী তার বাবা মায়ের পছন্দে কস্তুরবা মাখাঞ্জীকে (কাস্তুবাই নামেও পরিচিত ছিলেন) বিয়ে করেন। ১৮৮৫ সালে গান্ধী এবং তার স্ত্রী কস্তুরবা এর প্রথম সন্তান জন্ম নেয়।
ভারতীয় জাতির জনক কে?
ভারতের জাতির জনক হলেন মহাত্মা গান্ধী (মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী)। তিনি ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং ভারত সরকার তাঁকে এই সম্মানজনক উপাধি দিয়েছে।
মহাত্মা গান্ধীকে জাতির পিতা কে বলেছিলেন?
সুভাষ চন্দ্র বসু মহাত্মা গান্ধীকে জাতির পিতা বলে সম্বোধন করেছিলেন।


