বাংলা সাহিত্যের জগতে সর্বশ্রেষ্ঠ যদি কেউ থেকে থাকেন, তবে তিনি অবশ্যই আমাদের প্রিয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (Rabindranath Tagore Biography in Bengali)। নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রথম বাঙালি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২ হাজারেরও বেশি গান রচনা করেছেন। তাঁর লেখা অসাধারণ কবিতা ও গান আজও প্রত্যেক বাঙালীর হৃদয়কে স্পর্শ করে। “গীতাঞ্জলি” এবং “জীবন স্মৃতি” এর মতো রচনাগুলি বাংলার সাহিত্যপ্রেমীদের মনে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে ছিলেন ?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বাঙালি কবি, নাট্যকার, ছোটগল্পকার, চিত্রকর, অভিনেতা ও দার্শনিক। তাঁকে ‘কবিগুরু’ এবং ‘বিশ্বকবি’ নামে খ্যাতি দেওয়া হয়েছে। ১৯১৩ সালে তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘গীতাঞ্জলি’-এর ইংরেজি অনুবাদের জন্য তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলেন সব দেশের, সব কালের এবং সকল মানবজাতির জন্য এক অনন্য তীর্থভূমি।
Rabindranath Tagore Biography in Bengali
| নাম (Name) | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (Rabindranath Tagore) |
| জন্ম (Birthday) | ২৫ বৈশাখ ১২৬৮ বঙ্গাব্দ / ইং- ৭ই মে ১৮৬১, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি, কোলকাতা (7th May 1861, Jorasanko Thakurbari, Kolkata) |
| অভিভাবক (Guardian) / পিতা ও মাতা | দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (বাবা)সারদাসুন্দরী দেবী (মা) |
| ছদ্দনাম (Pseudonym) | ভানুসিংহ (Vanusingh) |
| দাম্পত্যসঙ্গী (Spouse) | মৃণালিনী দেবী (Mrinalini Devi) |
| পেশা (Career) | কবি, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, গল্পকার |
| উল্লেখযোগ্য রচনাবলী | গীতাঞ্জলী, রবীন্দ্র রচনাবলী, গোরা, আমার সোনার বাংলা, ঘরে বাইরে প্রভৃতি |
| উল্লেখযোগ্য পুরস্কার | নোবেল পুরস্কার (১৯১৩) |
| মৃত্যু (Death) | ২২ শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ / ইং- ৭ই আগস্ট ১৯৪১ (7th August, 1941) |
| মৃত্যুস্থান | জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি, কোলকাতা |
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম হয় ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ৭ই মে (বাংলা ১২৬৮ সালের ২৫শে বৈশাখ) কলকাতার জোড়াসাঁকোর এক অভিজাত ব্রাহ্মণ ঠাকুর পরিবারে। উনিশ শতকের সাহিত্য ও সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই ঠাকুর পরিবার।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা মাতা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতার নাম মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মাতার নাম সারদা দেবী, যিনি ছিলেন একজন স্নেহময়ী মহিলা। তাঁর পিতামহের নাম প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, যিনি একজন বিত্তশালী জমিদার ও জনহিতৈষী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ঠাকুর পরিবারের শিক্ষাব্যবস্থা, মার্জিত সাংস্কৃতিক চেতনা এবং পিতার আলোকিত ধর্মবিশ্বাস রবীন্দ্রনাথের মননে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পিতামাতার অষ্টম সন্তান ছিলেন। প্রায় ১৪ বছর বয়সে তার মা সারদা দেবীর মৃত্যু ঘটে।
সব খবর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শৈশবকাল
শিশুকাল থেকেই রবীন্দ্রনাথ অন্যান্য সন্তানদের মতো অভিজ্ঞ পরিচারকদের দ্বারা লালিত ও পালনপুষ্ট হন। তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় একজন জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা এবং কয়েকজন গৃহশিক্ষকের কাছে। কিছুদিন বিভিন্ন স্কুলেও পড়াশোনা করেন, তবে স্কুলের বাঁধাধরা নিয়ম ও পরিবেশ তার মনোরঞ্জনের সাথে মানিয়ে না যাওয়ায় বাড়িতেই শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। এতে তার সামনে জ্ঞান ও বিশ্বের সমস্ত দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যায়।
শৈশবে রবীন্দ্রনাথ কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নর্মাল স্কুল, বেঙ্গল অ্যাকাডেমি এবং সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলে কিছুদিন অধ্যয়ন করেছিলেন। কিন্তু বিদ্যালয়-শিক্ষায় অনাগ্রহী হওয়ায় বাড়িতে গৃহশিক্ষকের মাধ্যমে শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। ছেলেবেলায় তিনি জোড়াসাঁকোর বাড়ি, বোলপুর ও পানিহাটির বাগানবাড়িতে প্রাকৃতিক পরিবেশের মাঝে ঘুরে বেড়াতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা
১৮৭৩ সালে এগারো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের উপনয়ন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর তিনি কয়েক মাসের জন্য পিতার সঙ্গে দেশভ্রমণে বের হন। প্রথমে তারা শান্তিনিকেতনে গমন করেন। এরপর পাঞ্জাবের অমৃতসরে কিছু সময় কাটিয়ে শিখদের উপাসনা পদ্ধতি পরিদর্শন করেন। শেষে দেবেন্দ্রনাথ পুত্রকে নিয়ে পাঞ্জাবের (অধুনা ভারতের হিমাচল প্রদেশে) ডালহৌসি শৈলশহরের নিকটবর্তী বক্রোটায় যান। এখানে বসে রবীন্দ্রনাথ পিতার কাছ থেকে সংস্কৃত ব্যাকরণ, ইংরেজি, জ্যোতির্বিজ্ঞান, সাধারণ বিজ্ঞান এবং ইতিহাসের নিয়মিত পাঠ নিতে শুরু করেন।
অল্পবয়স থেকেই রবীন্দ্রনাথের কবিপ্রতিভা প্রকাশ পেতে শুরু করে। কিশোর বয়স থেকেই তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে কাব্যচর্চা শুরু করেন। মাত্র তেরো বছর বয়সে তার প্রথম কবিতা ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
১৮৭৮ সালে পড়াশোনার জন্য তিনি বিলেত (লন্ডন) যান। ব্যারিস্টার হওয়ার উদ্দেশ্যে লন্ডনে পাঠানো হলেও, সেখানে স্বল্পকাল অবস্থানের পর পাশ্চাত্য জীবনাচরণ, সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং সঙ্গীতের প্রভাব নিয়ে তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন। বড়ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের প্রেরণায় কবির প্রাণে নতুন সঙ্গীতের জোয়ার আসে এবং তিনি রচনা করেন অনবদ্য গীতিনাট্য ‘বাল্মিকী প্রতিভা’।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যৌবনকাল
১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম বই ‘কবিকাহিনী’ প্রকাশিত হয়। এর পর একে একে প্রকাশিত হয় তাঁর কাব্যগ্রন্থসমূহ—‘সন্ধ্যাসঙ্গীত’, ‘প্রভাতসঙ্গীত’, ‘ছবি ও গান’, ‘কড়ি ও কোমল’, ‘মানসী’, ‘সোনার তরী’। পরে বের হয় ‘চিত্রা’, ‘চৈতালী’, ‘কণিকা’, ‘কল্পনা’, ‘কথা ও কাহিনী’, ‘নৈবেদ্য’, ‘খেয়া’, ‘গীতাঞ্জলি’, ‘গীতালি’ প্রভৃতি।
শুধু কাব্যই নয়, নাটক, প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস, রসরচনা, সমালোচনা, রূপক নাটক, শিশুসাহিত্য, বিজ্ঞান, সমাজতত্ত্ব, শিক্ষাতত্ত্ব, সঙ্গীত, স্কুলপাঠ্য, ভ্রমণকাহিনী, সাহিত্য ও শিল্প—প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের বিচক্ষণতা ও স্বচ্ছন্দ বিচরণের ফলে বাংলা সাহিত্যের সর্বোচ্চ উৎকর্ষ সাধিত হয়। তিনি প্রায় দুই হাজারের মতো ছবি এঁকেছেন।
১৯১২ সালে ‘গীতাঞ্জলি’-এর ইংরেজি অনুবাদ লন্ডনের ইন্ডিয়া সোসাইটি থেকে প্রকাশিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক বিদগ্ধ সমাজে সাড়া পড়ে। ইংরেজি গীতাঞ্জলির ভূমিকা লেখেন আইরিশ কবি ডব্লিউ.বি. ইয়েস।
১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশরাজ রবীন্দ্রনাথকে ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগে নিরস্ত্র ভারতীয়দের উপর ব্রিটিশ সৈন্যদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি এই উপাধি প্রত্যাখ্যান করেন।
রবীন্দ্রনাথ ইউরোপ, আমেরিকা, চীন, জাপান, রাশিয়া, মালয়, পারস্য প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করেন এবং সেসব দেশে বহু বক্তৃতা ও রচনা পাঠ করেন। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি ভাষায় তাঁর রচনা প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বের সব দেশের বিদগ্ধ ব্যক্তি, কবি, লেখক ও বুদ্ধিজীবী তাঁকে মনীষী হিসেবে শ্রদ্ধা করেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কর্ম জীবন
ভারতী পত্রিকায় ১৮৭৭ সালে, মাত্র ১৬ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা প্রকাশ করেন। এসমস্ত রচনার মধ্যে ছিল ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী, ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-এর সমালোচনা এবং ‘ভিখারিণী’ ও ‘করুণা’ নামের দুইটি ছোটগল্প। এদের মধ্যে ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
এরপর ১৮৭৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কবিকাহিনী’। এছাড়াও তিনি রচনা করেন ‘সন্ধ্যাসংগীত’ নামক কাব্যগ্রন্থ, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিয়ে
ইংল্যান্ড থেকে দেশে ফিরে আসার পর, ১৮৮৩ সালের ৯ই ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিয়ে হয় বেণীমাধব রায়চৌধুরীর কন্যা ভবতারিণীর সঙ্গে, যিনি ঠাকুরবাড়ির এক অধস্তন কর্মচারীর কন্যা ছিলেন। বিয়ের সময় ভবতারিণীর নাম পুনঃনামকরণ করে রাখা হয় মৃণালিনী দেবী।
পরবর্তীকালে মৃণালিনী দেবী ও রবীন্দ্রনাথের পাঁচ সন্তান হয়। তাঁদের নাম যথাক্রমে—মাধুরীলতা (১৮৮৬–১৯১৮), রথীন্দ্রনাথ (১৮৮৮–১৯৬১), রেণুকা (১৮৯১–১৯০৩), মীরা (১৮৯৪–১৯৬৯) এবং শমীন্দ্রনাথ (১৮৯৬–১৯০৭)। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এঁদের মধ্যে অতি অল্প বয়সেই রেণুকা ও শমীন্দ্রনাথ মারা যায় ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষজীবন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনের শেষ চার বছর ছিল ধারাবাহিক শারীরিক অসুস্থতার সময়। এই সময়ে তাকে দুইবার অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় শয্যাশায়ী থাকতে হয়। ১৯৩৭ সালে একবার অচৈতন্য হয়ে কবির অবস্থা আশঙ্কাজনক হয়, কিন্তু সেবার তিনি সেরে ওঠেন। ১৯৪০ সালে আবার অসুস্থ হওয়ার পর আর তিনি পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি। এই সময়ে রচিত কবিতাগুলো মূলত মৃত্যুচেতনাকে কেন্দ্র করে তৈরি কিছু অবিস্মরণীয় পংক্তিমালা। মৃত্যুর মাত্র সাত দিন আগে পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টিশীল ছিলেন।
দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৯৪১ সালে জোড়াসাঁকোর বাসভবনেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বিশ্বকবি ও মহামনীষী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ৭ই আগস্ট তিনি কলকাতার জোড়াসাঁকোয় মহাপ্রয়াণ করেন। বাংলা ক্যালেন্ডার অনুসারে, ২৫শে বৈশাখের সূর্য (রবি) ২২শে শ্রাবণের সন্ধ্যায় অস্ত যায়।
শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেক বছর আগে বোলপুরের শান্তিনিকেতনে একটি বিশাল জমি কিনেছিলেন। সেখানে তিনি ১৮৮৮ সালে একটি আশ্রম এবং ১৮৯১ সালে একটি ব্রহ্মমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই জমিতে শিক্ষার ক্ষেত্র সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করেন। প্রথমে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন “পাঠ্য ভবন” নামে একটি স্কুল, যা অন্যান্য স্কুলের থেকে আলাদা ছিল, কারণ এটি সম্পূর্ণ খোলা আকাশের নিচে একটি গাছের তলায় পরিচালিত হতো।
১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর রবীন্দ্রনাথ সেই স্কুলকে আরও বিস্তৃত করার জন্য এটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করেন। পরবর্তীতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম রাখা হয় “বিশ্বভারতী”, যা ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।
সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে তিনি ১৯২৪ সালে আরেকটি শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন, যার নাম ছিল “শিক্ষা সত্র”। এই প্রতিষ্ঠানটি মাত্র ৭ জন শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু হয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অসংখ্য কবিতা রচনা করেছেন। তাঁর কবিতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু কাব্যগ্রন্থ হলো—‘মানসী’ (১৮৯০), ‘সোনার তরী’ (১৮৯৪), ‘চিত্রা’ (১৮৯৬), ‘চৈতালি’ (১৮৯৬), ‘কল্পনা’ (১৯০০) এবং ‘ক্ষণিকা’ (১৯০০)। এই কাব্যগ্রন্থগুলিতে রবীন্দ্রনাথের প্রেম ও সৌন্দর্য সম্পর্কিত রোম্যান্টিক ভাবনা ফুটে উঠেছে।
এছাড়াও ‘পলাতকা’ (১৯১৮) কাব্যগ্রন্থে তিনি গল্প-কবিতার আকারে নারীজীবনের সমসাময়িক সমস্যাগুলো তুলে ধরেছেন। বিশ্বের সর্বাপেক্ষা সুপরিচিত তাঁর কাব্যগ্রন্থ হলো ‘গীতাঞ্জলি’, যার জন্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটো গল্প
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ছোট গল্পকার ।তার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গল্প হল “কঙ্কাল”, “নিশীথে”, “মণিহারা”, “ক্ষুধিত পাষাণ”, “স্ত্রীর পত্র”, “নষ্টনীড়”, “কাবুলিওয়ালা”, “হৈমন্তী”, “দেনাপাওনা”, “মুসলমানীর গল্প” ইত্যাদি।
রবীন্দ্রনাথের একাধিক ছোটগল্প চলচ্চিত্র, নাটক ও টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মিত হয়েছে। তার গল্পের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রায়ণ হল সত্যজিৎ রায় পরিচালিত তিন কন্যা ও চারুলতা ,তপন সিংহ পরিচালিত অতিথি, কাবুলিওয়ালা ও ক্ষুধিত পাষাণ, পূর্ণেন্দু পত্রী পরিচালিত স্ত্রীর পত্র ইত্যাদি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মোট তেরোটি উপন্যাস রচনা করেছিলেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে—‘বৌ-ঠাকুরাণীর হাট’ (১৮৮৩), ‘রাজর্ষি’ (১৮৮৭), ‘চোখের বালি’ (১৯০৩), ‘নৌকাডুবি’ (১৯০৬), ‘প্রজাপতির নির্বন্ধ’ (১৯০৮), ‘গোরা’ (১৯১০), ‘ঘরে বাইরে’ (১৯১৬), ‘চতুরঙ্গ’ (১৯১৬), ‘যোগাযোগ’ (১৯২৯), ‘শেষের কবিতা’ (১৯২৯), ‘দুই বোন’ (১৯৩৩), ‘মালঞ্চ’ (১৯৩৪) এবং ‘চার অধ্যায়’ (১৯৩৪)। রবীন্দ্রনাথের প্রথম উপন্যাস রচনার প্রচেষ্টা ছিল ‘বৌ-ঠাকুরাণীর হাট’ ও ‘রাজর্ষি’।
‘বৌ-ঠাকুরাণীর হাট’ এবং ‘রাজর্ষি’ ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসেবে পরিচিত। ‘চোখের বালি’ উপন্যাসে সমসাময়িক সময়ের বিধবা নারীদের জীবনের নানা সমস্যা ফুটে উঠেছে।
রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস অবলম্বনে কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য সত্যজিৎ রায়ের ‘ঘরে বাইরে’ এবং ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘চোখের বালি’।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠান সমূহ
- বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় : ১৯২১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়টি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বীরভূম জেলার বোলপুর শহরে অবস্থিত।
- রবীন্দ্র সেতু: রবীন্দ্র সেতু (পূর্বনাম হাওড়া ব্রিজ) হুগলি নদীর উপর অবস্থিত কলকাতা ও হাওড়া শহরের মধ্যে সংযোগরক্ষাকারী সেতুগুলির মধ্যে অন্যতম হল রবীন্দ্র সেতু। ১৮৭৪ সালে প্রথম হাওড়া সেতু নির্মিত হয়। পরে ১৯৪৫ সালে পুরনো সেতুটির বদলে বর্তমান বহির্বাহু সেতুটির উদ্বোধন হয়। ১৯৬৫ সালের ১৪ জুন সেতুটির নাম পরিবর্তন করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে রবীন্দ্র সেতু রাখা হয়।
- রবীন্দ্রসদন: পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় অবস্থিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামাঙ্কিত একটি ঐতিহ্যবাহী সরকারি প্রেক্ষাগৃহ ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হল রবীন্দ্রসদন (পূর্বনাম রবীন্দ্রস্মরণী) । এটি দক্ষিণ কলকাতার নন্দন-রবীন্দ্রসদন সাংস্কৃতিক চত্বরে অবস্থিত।
- রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়: কলকাতার একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হল রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৬২ সালের ৮ মে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়।জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের প্রধান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হল এই বিশ্ববিদ্যালয়।
রবীন্দ্রনাথের পুরষ্কার
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ১৯৪০ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় শান্তিনিকেতনে আয়োজিত এক বিশেষ অনুষ্ঠানে “ডক্টরেট অব লিটারেচার” সন্মানে ভূষিত করে। বিদেশে তাঁর রচিত ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্য বিশেষ জনপ্রিয়তা পায়, যার সুবাদে ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারও লাভ করেন।
- ১৯১৫ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করে, তবে ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে তিনি সেই উপাধি ত্যাগ করেন। ১৯৩০ সালে রবীন্দ্রনাথের আঁকা একটি ছবি প্যারিস ও লন্ডনে প্রদর্শিত হয়। এছাড়াও তিনি জাপানের ডার্টিংটন হল স্কুলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।
- ভারতীয় ডাকবিভাগ ৭ই মে ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্মানে একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করে, যাতে তাঁর ছবি ব্যবহার করা হয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনের শেষ কিছু বছর ধারাবাহিক শারীরিক অসুস্থতার মধ্যে কেটেছে। রোগ যেন তাঁকে ছাড়তেই চাইছিল না। দুবার এমন গুরুতর অসুস্থতা দেখা দেয়, যার কারণে তাঁকে বহুদিন শয্যাশায়ী থাকতে হয়।
১৯৩৭ সালে একবার তিনি অচৈতন্য হয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থায় পড়েন। যদিও সেবার মাধ্যমে সেই সময় সুস্থ হয়ে উঠেন, তবে ১৯৪০ সালে আবার গুরুতর অসুস্থ হওয়ার পর আর সম্পূর্ণ সুস্থ হতে পারেননি। অবশেষে দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৯৪১ সালের ৭ই আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাসভবনেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স প্রায় ৮০ বছর হয়েছিল।


