২২ গজে যখন তিনি ব্যাট হাতে আগুন ঝরাচ্ছেন, তখন কে জানত সেই হাসিমুখের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক গভীর যন্ত্রণা? ভারতীয় ক্রিকেটের অন্যতম সফল নাম দীনেশ কার্তিক। তার ক্যারিয়ার যেমন চড়াই-উতরাইয়ে ভরা, তেমনি ব্যক্তিগত জীবনেও কম বিপর্যয় আসেনি। নিজের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকে অন্য কারও সঙ্গে চলে যেতে দেখার যন্ত্রণা সহজ নয় – আর সেটা তিনি নিজেই কষ্ট করে বুঝেছেন।
KKR-এর প্রাক্তন তারকা কার্তিক এক সময় একাধিক মানসিক ঝড়ের মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু সেখানেই থেমে থাকেননি। ভেঙে পড়লেও নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে আবারও ফিরেছেন মাঠে – আগের থেকেও বেশি ফোকাস নিয়ে। ব্যক্তিগত জীবনের কষ্টকে শক্তিতে পরিণত করে নিজের কেরিয়ারকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন তিনি।
দীনেশ কার্তিক। আসল নামটা কৃষ্ণকুমার দীনেশ কার্তিক। চেন্নাইয়ের একটি তেলেগু পরিবারে জন্ম হয় ভারতীয় তারকার। একেবারে খুদে বয়স থেকেই ক্রিকেটের প্রতি এক আজব টান ছিল তাঁর। আর সেই ভালবাসাকে পুঁজি করেই মাত্র 10 বছর বয়স থেকেই ক্রিকেটের যাত্রা শুরু করেন দীনেশ।
এভাবেই দীর্ঘ লড়াইয়ের পর ২০০৮ সালে অবশেষে ভারতের জাতীয় দলে অভিষেক হয় দীনেশ কার্তিকের। সেই মুহূর্তটা ছিল যেন তাঁর জীবনের একটা নতুন শুরু। দেশের জার্সি গায়ে পরে তিনি একাধিকবার প্রমাণ করেছেন – প্রতিভা থাকলে সঠিক সময়ে নিজেকে তুলে ধরা যায়। তিনি শুধু সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন, আর যখন সেই সুযোগ পেয়েছেন, তখন মাঠে ঝড় তুলেছেন ব্যাট হাতে।
জানিয়ে রাখা ভালো, দীনেশ কার্তিক ভারতের হয়ে ৩০০টি টি-টোয়েন্টি খেলা চতুর্থ ব্যাটসম্যান – এটা কিন্তু এমনিতেই নয়। ঘরোয়া হোক বা আন্তর্জাতিক মঞ্চ, তিনি যেখানেই খেলেছেন, নিজের আগ্রাসী ব্যাটিংয়ে রীতিমতো তাণ্ডব চালিয়েছেন।
দীনেশের ব্যক্তিগত জীবনের কঠিন অধ্যায়
দীনেশ কার্তিকের জীবনের প্রথম প্রেমের গল্পটা যেন একেবারে সিনেমার মতো। নিকিতা ভাঞ্জারা ছিলেন তাঁর ছেলেবেলার বন্ধু। একসঙ্গে বড় হওয়া, ছোট ছোট মুহূর্তে ভাগাভাগি করে নেওয়া হাসি-আনন্দ – সব মিলিয়ে সেই বন্ধুত্বটাই একসময় রূপ নেয় প্রেমে। অনেকদিনের আলাপচারিতা, ঘনিষ্ঠতা, আর একে অপরকে বোঝার মধ্য দিয়ে সেই সম্পর্ক পৌঁছে যায় জীবনের এক নতুন পর্যায়ে।
২০০৭ সালে, যখন দীনেশ মাত্র ২১ বছরের যুবক, তখন তিনি বিয়ে করেন শৈশবের সেই প্রিয় সঙ্গিনী নিকিতাকে। শুরুতে সব ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই সম্পর্কের ভিত নড়ে যেতে থাকে। দাম্পত্যে সুখ না থাকার কারণ হিসেবে অনেক কিছু উঠে এসেছে, তবে বড় ধাক্কাটা আসে যখন নিকিতা এক অপ্রত্যাশিত সিদ্ধান্ত নেন – যেটা দীনেশের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে।
জীবনের সব গল্প তো সুখের নয়, কিছু কিছু অধ্যায় শুধুই কষ্টের। দীনেশ কার্তিকের ব্যক্তিগত জীবনের এক এমনই যন্ত্রণাদায়ক অধ্যায় শুরু হয় তাঁর বৈবাহিক জীবনের ভাঙনের মধ্য দিয়ে। জানা যায়, বিয়ের কিছু বছর কাটতেই তাঁর স্ত্রী নিকিতা প্রেমে পড়েন দীনেশেরই একসময়ের সতীর্থ এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু মুরলি বিজয়ের। ভাবুন একবার, যার সঙ্গে আপনি মাঠে ঘাম ঝরিয়ে খেলেছেন, যাকে আপনি বন্ধু বলে ভেবেছেন, সেই মানুষটির সঙ্গেই গোপনে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছেন আপনার জীবনসঙ্গিনী – সেটা মানসিকভাবে কতটা ভেঙে দেওয়ার মতো হতে পারে!
সূত্র অনুযায়ী, সালটা ছিল ২০১২। তখন বিজয় হাজারে ট্রফির একটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ চলছিল। সেই টুর্নামেন্ট চলাকালীনই দীনেশ জানতে পারেন, তাঁর স্ত্রী নিকিতা আর মুরলি বিজয়ের মধ্যে গড়ে উঠেছে এক নতুন সম্পর্ক।
এই খবর কানে আসতেই প্রথম ধাক্কা খান নাইট প্রাক্তনী। তবে সেখানেই শেষ নয়, স্ত্রীয়ের এমন গোপন কীর্তি জেনে বৈবাহিক সম্পর্ক বিচ্ছেদের পর ভারতীয় তারকা জানতে পারেন, নিকিতার গর্ভে যে সন্তান রয়েছে তা বন্ধু মুরলি বিজয়ের। এক কথায়, বন্ধুর সন্তানের মা হতে চলেছেন প্রাক্তন স্ত্রী। আর এমন দুর্ভাগ্যের মাঝেই একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন ভারতীয় তারকা দীনেশ কার্তিক।
২২ গজের গর্জন, জিমের ঘাম—সবকিছু এক সময় হঠাৎ করেই থমকে গিয়েছিল দীনেশ কার্তিকের জীবনে। মাঠের চেনা কোলাহল ছেড়ে, জীবনের এক নিঃসঙ্গ অধ্যায়ে পা রাখেন তিনি। যখন একদিকে প্রাক্তন স্ত্রী নিকিতা নতুন জীবনে এগিয়ে যান মুরলি বিজয়ের সঙ্গে বিয়ে করে, তখন অন্যদিকে দীনেশ ডুবে যান গভীর একাকিত্বে।
বৈবাহিক জীবনের এই ঝড় তাঁর মনকে এতটাই বিপর্যস্ত করে দেয় যে, ধীরে ধীরে তিনি অবসাদ বা ডিপ্রেশনের কবলে পড়েন। এই মানসিক চাপে তাঁর পারফরম্যান্সেও প্রভাব পড়ে। আর তার ফলস্বরূপ, একসময় ভারতীয় দল থেকেও বাদ পড়তে হয় তাঁকে।
সব হারিয়ে ফেললেও দীনেশ কার্তিকের জীবনে তখন এক আলো হয়ে আসেন অভিষেক নায়ার—বন্ধু, মেন্টর, এবং জীবনের কঠিন সময়ে এক সত্যিকারের সহায়। তাঁর পরামর্শে, ধৈর্য আর পরিশ্রমে ভর করে ধীরে ধীরে নিজেকে গড়ে তোলেন নতুন করে। পুরনো দীনেশ যেন আবার জেগে ওঠে, তবে এবার আরও পরিণত, আরও শক্ত।