ব্যথা মানেই প্যারাসিটামল? নিছক মাথাব্যথা ভেবে ভুল করবেন না। মাইগ্রেন কখনও কখনও এতটাই ভয়ঙ্কর চেহারা নেয় যে রোগীকে হাসপাতালে পর্যন্ত ভর্তি করতে হতে পারে। যন্ত্রণা যদি মাত্রাতিরিক্ত হয়, অনেক সময় মানুষ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
তাই মাথাব্যথাকে হালকা করে দেখা একদম ঠিক নয়। ঘন ঘন ব্যথা হলে, নিজের ইচ্ছেমতো পেনকিলার খাওয়া বন্ধ করুন। বরং একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াটাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।
মাইগ্রেন যে কতটা জটিল হতে পারে, তার পেছনের কারণ কী, কোন কোন ধাপে এই ব্যথা বাড়ে এবং কিভাবে কিছুটা হলেও উপশম মেলে—এই সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আনন্দবাজার ডট কমের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করলেন স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সুপর্ণ গঙ্গোপাধ্যায়।
ব্যথা মানেই প্যারাসিটামল?
মাইগ্রেন কী
চিকিৎসক বলছেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত মাইগ্রেনের ব্যথার কোনও কারণ খুঁজে বার করা যায়নি। তবে কিছু গবেষণার উপর ভিত্তি করে এটুকু বোঝা গিয়েছে যে, এই রোগের নেপথ্যে বড় ভূমিকা রয়েছে জিনের। মা অথবা বাবা, কিংবা মা-বাবা দু’জনেরই এই রোগ ছিল। তাঁদের থেকেই সন্তানের মাইগ্রেন।’’
মাইগ্রেনের সময় শরীর থেকে কিছু রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত হয়। আর তার ফলেই অত্যধিক ব্যথা হতে থাকে। ধমনী দিয়ে রক্ত চলাচল বেড়ে যায়। সেই কারণেই মাইগ্রেনের ব্যথায় মাথা দপদপ করতে থাকে। শরীরে রাসায়নিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়া থেকেই মাইগ্রেনের সূত্রপাত।
কী কী কারণে রাসায়নিক ভারসাম্য নষ্ট হয়
যাঁদের জিনগত কারণে মাইগ্রেনের প্রবণতা আছে, তাঁদের ক্ষেত্রে শুধু ওষুধেই সমস্যার পুরো সমাধান হয় না। আসলে, জীবনযাপনের ধরন আর শরীরের ভেতরের কিছু প্রক্রিয়াও বড়সড় ভূমিকা নেয়—যা মাইগ্রেনের ব্যথাকে আরও অসহনীয় করে তোলে।
চিকিৎসকরা বলছেন, পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মধ্যে মাইগ্রেনের প্রকোপ অনেক বেশি। এর মূল কারণ হল হরমোনের ওঠানামা। বিশেষ করে মাসিকের সময় হরমোনের যে পরিবর্তন ঘটে, তা মাইগ্রেনকে আরও সক্রিয় করে তোলে।
পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি ৫ জন মহিলার মধ্যে ১ জন মাইগ্রেনে ভোগেন। পুরুষদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম—প্রতি ১০ জনে ১ জন। আর শিশুদের ক্ষেত্রে প্রতি ১৫ জনে ১ জনের এই সমস্যা দেখা যায়।
তবে একটা মজার (এবং গুরুত্বপূর্ণ) তথ্য হল—শিশুদের মাইগ্রেন সবসময় মাথাব্যথা হিসেবে প্রকাশ পায় না। অনেক সময় তাদের মাইগ্রেনের ব্যথা পেটে হয়, যেটাকে বলা হয় abdominal migraine। তাই অনেক সময় বুঝতেও দেরি হয়।
ঘুম যদি নিয়মমতো না হয়, বা বারবার ঘুমের সময় বদলে যায়—তাহলে কিন্তু মাইগ্রেনের কষ্টটা অনেক বেশি বাড়তে পারে। ঠিকঠাক ঘুম না হলে শরীর যেমন ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তেমনই মাইগ্রেনও হয়ে পড়ে আরও তীব্র।
মেঘলা দিন মানেই অনেকের জন্য মাইগ্রেনের যন্ত্রণা বেড়ে যাওয়ার দিন। আসলে, আবহাওয়ার হঠাৎ পরিবর্তনে শরীরের ভেতরে পানির পরিমাণ কমে যেতে পারে, আর সেটাও মাইগ্রেনকে বাড়িয়ে তোলে। তাই মেঘলা বা হঠাৎ গরম-ঠান্ডা হওয়া দিনে জল খাওয়ার দিকে একটু বেশি খেয়াল রাখা খুব জরুরি।
অনেকে ওজন কমানোর জন্য প্রয়োজনের থেকেও বেশি শরীরচর্চা করে ফেলেন, আবার কারও পেশাগত কারণে ঠিকমতো বিশ্রামের সময়ই মেলে না। কিন্তু জানেন কি? এই অতিরিক্ত সক্রিয়তা—মানে একটানা দৌড়ঝাঁপ, ক্লান্তি—মাইগ্রেনের জন্য মোটেও ভালো না। বরং এতে মাথাব্যথা আরও বেড়ে যেতে পারে। তাই শরীরচর্চা ভালো, তবে তারও একটা সীমা থাকা দরকার। বিশ্রামটাও ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ।
কাজের চাপেই হোক বা সময়ের অভাবে—অনেকেই একটা না একটা মিল (যেমন জলখাবার, দুপুরের খাবার বা রাতের খাওয়া) মিস করে দেন। কিন্তু নিয়ম করে খাওয়া না হলে, শরীর যেমন দুর্বল হয়ে পড়ে, তেমনই মাইগ্রেনের সম্ভাবনাও বাড়ে। সময়মতো পেট ভরিয়ে খাওয়া না হলে, রক্তে শর্করার পরিমাণ কমে যায়—আর সেটাই মাথাব্যথার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই যত ব্যস্তই থাকুন, খাওয়াদাওয়া কখনও যেন অবহেলিত না হয়।
তাছাড়া, মানসিক চাপ, অতিরিক্ত ক্যাফিন খাওয়া বা ধূমপানের মতো অভ্যাসও মাইগ্রেনকে বাড়িয়ে দিতে পারে—বলছেন চিকিৎসকরা। শুধু তাই নয়, কিছু নির্দিষ্ট খাবার থেকেও সাবধান থাকা দরকার।
যেমন: পুরনো চিজ়, ডার্ক চকোলেট, রেড ওয়াইন, নুডলসের মতো মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট (MSG) যুক্ত খাবার, কৃত্রিম সুইটনার, কিংবা আচারের মতো সংরক্ষিত খাবার—এইসবই মাইগ্রেনের ট্রিগার হতে পারে। তাই যাঁদের মাইগ্রেনের প্রবণতা আছে, তাঁদের জন্য এসব খাবার যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলাই ভালো।
মাইগ্রেনের ব্যথা থেকে মুক্তির উপায় কী
চিকিৎসক বলছেন, ‘‘মাইগ্রেনকে রোধ করা আর মাইগ্রেন হওয়ার পর সেটির তীব্রতা কমানো, দু’টি আলাদা। চিকিৎসকেরা রোগীর অবস্থা পরীক্ষা করে বিভিন্ন ওষুধ দেন। কিন্তু তা ছাড়াও ঘরোয়া কিছু উপায়ে এই রোগের উপশম সম্ভব।’’
মাইগ্রেনের সমস্যা থেকে পুরোপুরি মুক্তি না মিললেও, কিছু সহজ পরিবর্তন এনে কিন্তু জীবন অনেকটাই স্বস্তির হতে পারে। যেমন, যেসব খাবার মাইগ্রেন বাড়ায়—সেগুলো এড়িয়ে চলা, প্রতিদিন ঠিকঠাক ঘুমোনো, খুব বেশি সময় ফোন বা ল্যাপটপের সামনে না থাকা এগুলো খুবই জরুরি। পাশাপাশি, ভিটামিন-সমৃদ্ধ খাবার বা প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খাওয়া, প্রতিদিন শ্বাস-প্রশ্বাসের কিছু সহজ যোগাভ্যাস করা, আর পর্যাপ্ত পরিমাণে জল খাওয়া—এই ছোট ছোট অভ্যাসগুলো নিয়ম করে মানলে অনেকটাই কমে যেতে পারে মাইগ্রেনের দাপট।
মাইগ্রেনের ব্যথা শুরু হলে কী করবেন? চিকিৎসকরা বলছেন—সবচেয়ে আগে প্রয়োজন শান্ত একটা পরিবেশ। একটা অন্ধকার, নিরিবিলি ঘরে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থাকুন বা শুয়ে পড়ুন। চারপাশের আলো, শব্দ—সবকিছু থেকে কিছু সময় দূরে থাকলে মাথা হালকা লাগতে শুরু করে।
চাইলে ঘাড় ও কপালে ঠান্ডা বা গরম কাপড় দিয়ে হালকা সেঁক দিতে পারেন। এতে অনেক সময় আরাম মেলে। এমনকি, নিজে হাতে মাথার তালু আর কপালের দু’পাশে একটু মালিশ করলেও উপকার মিলতে পারে।
এর পাশাপাশি, নিয়ম করে শ্বাস-প্রশ্বাসের সহজ যোগ অভ্যাস (যেমন অনুলোম-বিলোম) করলে ব্যথার তীব্রতাও অনেকটাই কমে যায়। মানে এক কথায়, একটু সময় নিজের জন্য রাখলেই মাইগ্রেনের মতো কষ্টকর ব্যথাকেও সামলানো যায় সহজভাবে।
চিকিৎসক সুপর্ণ গঙ্গোপাধ্যায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেছেন। তিনি বলছেন, “অনেকেই মাইগ্রেনের ব্যথা হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ না নিয়ে যখন-তখন প্যারাসিটামল খেয়ে নেন। কিন্তু এটা খুবই খারাপ অভ্যাস। কারণ, মাইগ্রেন ভেবে অনেক সময় আরও বড় কোনও অসুস্থতাকে আমরা অবহেলা করে ফেলি।”
তিনি আরও জানান, অনেক সময় ব্যথা একটু কমে গেলেও ভেতরে ভেতরে কোনও জটিল রোগ লুকিয়ে থাকতে পারে। আর দেরিতে ধরা পড়লে তখন চিকিৎসাও কঠিন হয়ে পড়ে।