মাথার তালুতে ব্যথা কারণ: মাথাব্যথা তো এমন একটা সমস্যা, যা প্রায় সবাই কখনও না কখনও অনুভব করেন। কখনও খুব সাধারণ কারণে। যেমন চাপ বা ক্লান্তি, আবার কখনও মাথাব্যথা হতে পারে মারাত্মক কোনো রোগের লক্ষণও। মাথাব্যথা আসলে নানা ধরনের হতে পারে—কেউ সারা মাথায় অনুভব করেন, আবার কেউ পেয়ে থাকেন আধকপালি ব্যথা, বিশেষ করে মাথার পেছন দিকের অংশে। আজকে আমরা আলোচনা করব বিশেষ করে মাথার পেছনের দিকে ব্যথা নিয়ে।
Table of Contents
মাথার পেছন দিকে ব্যথা হলে কী করবেন
অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা বা স্ট্রেস অনেক সময় মাথাব্যথার কারণ হতে পারে। যেটাকে আমরা “টেনশন টাইপ হেডেক” বলি। এই ব্যথা সাধারণত মাথার পেছনে বা পুরো মাথায় একটা ভোঁতা অনুভূতি তৈরি করে। যেন মাথার চারপাশে একটা ব্যান্ড বাঁধা হয়ে গেছে। ঘাড়ের পেশিতে টান অনুভব করা যায়। আর মাঝে মাঝে চোখে ব্যথাও থাকতে পারে। এই ধরনের ব্যথা সাধারণত অতিরিক্ত কাজের চাপ, মানসিক উদ্বেগ বা বেশি দুশ্চিন্তা থেকে শুরু হয়। তবে একটু বিশ্রাম নিলে বা ব্যথার ওষুধ খেলে এই ব্যথা কমে যায়।
মাইগ্রেন: মাইগ্রেনের কারণে মাথার একপাশে ব্যথা হলেও অনেক সময় পেছন থেকে তীব্র ব্যথা শুরু হতে পারে। এই ব্যথার সঙ্গে বমি ভাব, আলোর প্রতি অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা এবং চোখে ব্যথা থাকতে পারে।
ঘাড়ের পেশিতে টান: অনেক সময় অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে বেশিক্ষণ বসে থাকা বা ঘুমানোয় ঘাড়ের পেশিতে টান লাগে। এর ফলে মাথার পেছনে তীব্র ব্যথা অনুভব হয় এবং মাথা ও ঘাড় নাড়াতে কষ্ট হতে পারে।
স্পন্ডিলাইটিস: যারা ডেস্কে দীর্ঘ সময় বসে কাজ করেন, বিশেষ করে যারা কম্পিউটার বা টেবিলের সামনে দীর্ঘক্ষণ সময় কাটান, তাদের মধ্যে সারভাইক্যাল স্পন্ডিলাইটিস হতে পারে। এতে মাথার পেছনে ব্যথা হতে দেখা যায়।
রক্তচাপের সমস্যা: হঠাৎ রক্তচাপ বেড়ে যাওয়াও বা কমে যাওয়াও মাথার পেছনে ব্যথার কারণ হতে পারে।
আঘাতজনিত: মাথার পেছনে আঘাত লাগলে বা অস্থিসন্ধিতে কোনো সমস্যা হলে মাথাব্যথা হতে পারে। সেলুনে মাথা ম্যাসাজ করালেও পেশিতে আঘাত পেয়ে মাথায় ব্যথা হয়।
সাইনাস সংক্রমণ: ঠান্ডা লেগে সাইনাসে সংক্রমণ হলে মাথার পেছনসহ যেকোনো জায়গায় ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
মাথার পেছন দিকে ব্যথা হলে করণীয় কী
- পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন: শরীরকে ভালোভাবে বিশ্রাম দিতে হবে।
- মানসিক চাপ কমানোর চেষ্টা করুন: স্ট্রেস বা মানসিক চাপ কমানোর জন্য বিভিন্ন উপায় চেষ্টা করুন—যেমন শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম, মেডিটেশন বা হাঁটাহাঁটি।
- ঘুমানোর সময় সঠিক ভঙ্গিতে থাকুন: ঘুমানোর সময়ে সঠিক ভঙ্গি বজায় রাখলে ঘাড় এবং মাথার পেছনে চাপ কমে, ফলে ব্যথা কমতে পারে।
- রক্তচাপ নিয়মিত পরীক্ষা করুন: রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা গুরুত্বপূর্ণ। তাই নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করে তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
- ব্যথা হলে প্যারাসিটামল–জাতীয় ওষুধ খেতে পারেন: সাধারণ মাথাব্যথা হলে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ গ্রহণ করতে পারেন, তবে এটা বেশি সময় ব্যবহার না করাই ভালো।
- বেশি ব্যথা হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন: যদি ব্যথা বেশি হয়ে থাকে বা বারবার হয়, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মাথার তালুতে ব্যথা কারণ
মাথার ত্বকে ব্যথার বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে, যেমন টেনশন হেডেক, স্কাল্প ইনফেকশন, বা স্কাল্প সোরিয়াসিস। ব্যথার কারণ অনুসারে, আপনি কিছু সহজ উপায়ে ব্যথা উপশম করতে পারেন:
- ওভার-দ্য-কাউন্টার ব্যথা উপশমকারী: আইবুপ্রোফেন বা অ্যাসিটামিনোফেন ব্যবহার করলে প্রদাহ কমে এবং ব্যথা উপশম হতে পারে।
- উষ্ণ সংকোচ: প্রভাবিত এলাকায় একটি উষ্ণ সংকোচ প্রয়োগ করলে পেশী শিথিল হয় এবং রক্ত সঞ্চালন ভালো হয়, যা ব্যথা কমাতে সহায়ক।
- প্রাকৃতিক তেল: নারকেল বা জলপাই তেলের মতো তেল দিয়ে মাথার ত্বকে আলতোভাবে ম্যাসাজ করলে রক্তসঞ্চালন উন্নত হয় এবং পেশীতে টান কমে।
- চুলের স্টাইল: টাইট পনিটেল বা বিনুনি এড়িয়ে চলা মাথার ত্বকে উত্তেজনা কমাতে সাহায্য করতে পারে।
- মৃদু শ্যাম্পু: খুশকি বা শুষ্ক মাথার ত্বক থাকলে মৃদু শ্যাম্পু এবং কন্ডিশনার ব্যবহার করুন, এবং প্রদাহ কমাতে মেডিকেটেড শ্যাম্পু ব্যবহার করতে পারেন।
- গরম সরঞ্জাম এড়ানো: চুলের ড্রায়ার বা গরম সরঞ্জামগুলি মাথার ত্বক শুষ্ক করতে পারে, তাই এগুলি ব্যবহার না করা ভালো।
যদি ব্যথা অব্যাহত থাকে বা আপনি কোনো অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখেন, যেমন লালভাব, ফোলাভাব, বা স্রাব, তবে একজন চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করা উচিত।
মাথার কোন দিকের ব্যথা কোন রোগের লক্ষণ?
মাথার একপাশে যে ব্যথা শুরু হয়, সেটা সাধারণত আধ-কপালি ব্যথা বা মাইগ্রেন নামে পরিচিত। মাইগ্রেনের ব্যথা সাধারণত দপদপ করতে থাকে এবং কিছুক্ষণ পর সেটি পুরো মাথায় ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া, চোখের চারপাশেও ব্যথা অনুভব হতে পারে, যা মাইগ্রেনের আরও এক সাধারণ উপসর্গ। এই ধরনের ব্যথা সাধারণত অনেক তীব্র হয় এবং নানা কারণে উদ্ভূত হতে পারে, যেমন টেনশন, পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব বা কোনো বিশেষ খাবারের প্রতিক্রিয়া।
টেনশন হেডেক: টেনশনের কারণে মাথাব্যথা হলে সাধারণত পুরো মাথা জুড়ে ব্যথা অনুভূত হয়। মনে হতে পারে, যেন কেউ মাথাটা চাপ দিয়ে ধরে রেখেছে। সেই সঙ্গে মাথা ভারী লাগতে পারে, এবং অনেক সময় এই ব্যথা চলতেই থাকে।
ক্লাস্টার হেডেক: ক্লাস্টার হেডেক সাধারণত দিনে নির্দিষ্ট একটা সময় বা বছরে বিশেষ কোনো সময়ে হতে পারে। এতে চোখের পিছনের দিক থেকে মাথার একপাশে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়, যা খুব যন্ত্রণাদায়ক হতে পারে।
মাথার ভিতরে রক্তপাত: মাথার পিছন দিক থেকে শুরু হয়ে ঘাড় পর্যন্ত প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হয়, এবং এই ধরনের ব্যথা খুবই তীব্র ও অসহনীয় হতে পারে। এটি গুরুতর সমস্যা হতে পারে, তাই এমন ব্যথা হলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
ব্রেন ইনফেকশন বা মেনিনজাইটিস: এই ধরনের ইনফেকশনে পুরো মাথাজুড়ে তীব্র ব্যথা হয়, সঙ্গে ঘাড়েও ব্যথা অনুভূত হতে পারে। এটি খুবই গুরুতর সমস্যা এবং তাড়াতাড়ি চিকিৎসা নেওয়া উচিত।
চোখের পাওয়ার বাড়লে: যখন চোখের পাওয়ার বাড়ে, তখন চোখের চারপাশে ব্যথা এবং মাথার মধ্যে ব্যথা অনুভূত হতে পারে, যা বেশ অস্বস্তিকর।
ভেনাস সাইনাস: যদি মাথার ভেতরে ভেনাস সাইনাসে ক্লট হয়, তাও ব্যথার কারণ হতে পারে। এই ব্যথা অনেক সময় খুব তীব্র এবং দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
ব্রেন টিউমার: ব্রেন টিউমার যদি মাথার ডান পাশে টেম্পোরাল লোবে হয়, তবে সেই অংশে ব্যথা অনুভূত হয়। টিউমার যদি ছোট হয়, তবে ব্যথা কম হতে পারে, কিন্তু যদি এটি বড় আকারে বৃদ্ধি পায়, তবে তা তীব্র ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
বয়স্কদের মাথাব্যথা: বয়স্কদের মধ্যে কানের পিছনে টেম্পোরাল আর্টারিতে “টেম্পোরাল আর্টারাইটিস” নামক একটি অসুখ হতে পারে, যার ফলে কানের পিছনে তীব্র ব্যথা হতে পারে।
সাইনাস ইনফেকশন: সাইনাস ইনফেকশনের কারণে মুখমণ্ডলে ব্যথা হতে পারে, যা নাক, গাল বা চোখের চারপাশে অনুভূত হয় এবং বেশ অস্বস্তিকর হতে পারে।
কখন যাবেন ডাক্তারের কাছে?
কম-বেশি সকলেরই কখনও না কখনও মাথা যন্ত্রণা হয়। কারও হয় তীব্র এবং অসহনীয়, আবার কারও হয় মৃদু। অনেক সময় বাজারচলতি ওষুধ খেয়ে বা মলম লাগিয়ে মাথাব্যথার কিছুটা উপশম হয়। আবার কিছুটা বিশ্রাম বা ঘুমালে কষ্ট চলে যায়। তবে মাথাব্যথা হলেই অনেক সময় কেউ ডাক্তারের কাছে তাড়াতাড়ি ছুটে যান না। তবে যদি জীবনে প্রথমবার মারাত্মক মাথাব্যথা অনুভব করেন, তাহলে অবশ্যই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। এছাড়া, যদি আপনার বয়স ৫৫ বছরের উপরে হয় এবং প্রথমবার মাথাব্যথার সমস্যায় পড়েন, তবে সেটিও চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
মাথা যন্ত্রণার সঙ্গে যদি জ্বর বা বমি শুরু হয়, তাহলে এটি ইনফেকশন, মেনিনজাইটিস বা মাথার ভিতরে রক্তপাতের লক্ষণ হতে পারে। এছাড়া, যদি মাথাব্যথার সঙ্গে দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে যায় তাহলে একদমই তা উপেক্ষা করবেন না। যদি মাথাব্যথার সঙ্গে কোনও নিউরোলজিক্যাল সমস্যা দেখা দেয়। যেমন হাত-পায়ে সাড়া চলে যাওয়া বা এক দিকে প্যারালাইসিসের লক্ষণ দেখা দেওয়া। তাহলে খুব সাবধান থাকতে হবে। এছাড়া, যদি আপনি ঝিমিয়ে পড়েন বা পরিচিত মানুষদের চিনতে না পারেন, তাহলে দ্রুত নিউরোলজিস্টের কাছে যাওয়া উচিত।
ওষুধ ছাড়া ভাল থাকার উপায়
মাইগ্রেনের রোগীদের যখন প্রচণ্ড মাথাব্যথা হয় তখন ডাক্তার কিছু ওষুধ দেন যাতে ব্যথা কমে। কিন্তু এই ওষুধ এক সময়ে নির্দিষ্ট পরিমাণে নেওয়া বন্ধ করতে হয়, এবং তা ডাক্তারকের পরামর্শ অনুযায়ী বন্ধ করা উচিত। মাইগ্রেনের আক্রমণ এড়াতে, জীবনযাত্রা একটু পরিবর্তন করা প্রয়োজন। খালি পেটে বেশি সময় থাকা, রাত জেগে থাকা এবং হঠাৎ রোদে বের হওয়া এড়িয়ে চলা উচিত। ঘুমের ক্ষেত্রে, কম বা অতিরিক্ত ঘুম একদম নয়—প্রতিদিন ছ-সাত ঘণ্টা ভালো ঘুম প্রয়োজন। পর্যাপ্ত জল খাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্ট্রেস থেকেও দূরে থাকতে হবে, তাই যোগাভ্যাস বা ধ্যানের মাধ্যমে চাপমুক্ত থাকার চেষ্টা করুন। এছাড়া, নিয়মিত হাঁটাহাঁটি করলে শরীরের জন্যও উপকারি হবে।