ভেষজ চিকিৎসায় মেথির ব্যবহার কিন্তু নতুন কিছু নয়। বহু যুগ ধরেই আমাদের দাদিমারা মেথিশাক আর মেথির বীজ দিয়ে নানা সমস্যার সমাধান করে এসেছেন। শুধু রান্নায় স্বাদ বাড়ায় না, এই ছোট্ট ভেজিটা কিন্তু শরীরকেও রাখে দারুন ফিট।
মেথিশাক তারুণ্য ধরে রাখতে সাহায্য করে—মানে ত্বক থাকবে ঝকঝকে, আর চুলও থাকবে ঘন আর মজবুত। যাঁরা ডায়াবেটিস বা হতাশায় ভোগেন, তাঁদের জন্যও মেথিশাক খুবই উপকারী। শরীরের ভেতরকার সুস্থতাকে যেমন বজায় রাখে, তেমনি বাইরে থেকেও আপনাকে সুন্দর রাখে—একেবারে অল-রাউন্ডার বলা যায় একে!
ভাবছেন, পুষ্টিগুণে কী আছে এতে? মাত্র ১০০ গ্রাম মেথিশাকেই আপনি পাবেন প্রায় ৫০ ক্যালরি শক্তি। এর সঙ্গে রয়েছে ১.৫ গ্রাম স্যাচুরেটেড ফ্যাট, ৬৭ মিলিগ্রাম সোডিয়াম, ৭৭০ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম, ৫৮ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট এবং চমকে যাওয়ার মতো ২৩ গ্রাম প্রোটিন! এছাড়াও এতে থাকে ভিটামিন সি, বি৬, ক্যালশিয়াম, আয়রন আর ম্যাগনেশিয়ামের মতো জরুরি সব পুষ্টি উপাদান।
মেথিশাকের ১০টি গুণ
ওজন কমায়
মেথিশাক মানেই হাই-ফাইবারের পাওয়ারহাউস। আর শুধু ফাইবার না—এর সঙ্গে আছে আরও অনেক দরকারি পুষ্টি উপাদান। বেশি ফাইবার থাকার কারণে মেথিশাক খেলে অনেকক্ষণ পেট ভরা থাকে। ফলে ঘন ঘন ক্ষুধাও লাগে না, আর স্বাভাবিকভাবেই খাওয়ার পরিমাণও কমে যায়। যারা ওজন কমানোর চেষ্টা করছেন বা বেশি খাওয়া কমাতে চান, তাদের জন্য মেথিশাক একেবারে যেন খাবারের বন্ধু!
কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ রাখে
রক্তের লিপিড লেভেলকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। কেননা এটি কোলেস্টেরলের এলডিএল বা লো ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন ও এইচডিএল বা হাইডেনসিটি লাইপোপ্রোটিনের মধ্যে ভারসাম্যকে বজায় রাখে।
অ্যান্টি-ডায়াবেটিক এলিমেন্ট
ডায়াবেটিস থাকলে খাবার নিয়ে একটু বেশিই চিন্তা করতে হয়, তাই না? তবে চিন্তার কিছু নেই, কারণ মেথিশাক আপনার পাশে আছে!
মেথি শরীরের গ্লুকোজ মেটাবলিজম, অর্থাৎ রক্তে শর্করার ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণে দারুন কাজ করে। এই কারণেই ভেষজ চিকিৎসায় মেথিকে ‘অ্যান্টি-ডায়াবেটিক এলিমেন্ট’ বলা হয়। মানে, এটা রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়তে দেয় না—বরং তা নিয়ন্ত্রণে রাখে। যারা ডায়াবেটিসে ভুগছেন, তাঁদের জন্য এটা যেন একপ্রকার প্রাকৃতিক ওষুধের মতো! নিয়মিত মেথিশাক খেলে শুধু রক্তে চিনি কমে না, সঙ্গে বাড়ে স্বস্তিও।
হার্টের সমস্যার ক্ষেত্রে উপকারী
মেথিশাক প্লাটিলেট বৃদ্ধির গতিকে কমায়। ফলে হৃৎপিণ্ডে রক্ত জমে যাওয়ার মতো বিপজ্জনক সম্ভাবনাকে কমিয়ে দেয়। এর ফলে হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশে কমে যেতে পারে। এ ছাড়া এটি হার্ট রেট ও ব্লাডপ্রেশার নিয়ন্ত্রণে রাখতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।
পেটের সমস্যায় উপকারী
লিভারের যত্নে মেথিশাক হতে পারে ভরসার সাথী। শুধু লিভার নয়, গ্যাসের সমস্যা বা অন্ত্রের নানা রকমের অস্বস্তিতেও মেথিশাক দারুণ কাজ করে। ডায়েরিয়া হলে ঘরোয়া উপায়ে স্বস্তি পেতে চাও? মেথিশাক এক্ষেত্রেও সাহায্য করতে পারে। সোজা কথায়, আমাদের রান্নাঘরের এই সবুজ পাতা শুধু স্বাদেই নয়, স্বাস্থ্যের দিক থেকেও বেশ কার্যকরী।
চুলের যত্নে মেথিশাকের ব্যবহার
চুল পড়া, খুশকি কিংবা অকালে পাকা চুল—সব সমস্যার সহজ সমাধান হতে পারে মেথিশাক! এতে থাকা আয়রন ও ভিটামিন চুলের গোড়া মজবুত করে, খুশকি দূর করে আর পাকা চুলের সমস্যা কমাতেও সাহায্য করে। নিয়মিত ব্যবহার করলে চুল ঘন ও মসৃণ হয়ে উঠতে পারে। আর এই উপকার পেতে চাইলে ঘরেই তৈরি করে নিতে পারো মেথি তেল—একেবারে প্রাকৃতিক উপায়, কেমিক্যাল ছাড়াই।
মেথি তেল তৈরি করে ফেলা যায় বাড়িতেই। একটি পাত্রে কিছুটা নারিকেল তেল নিন। তার মধ্যে কয়েকটি মেথি পাতা ফেলে দিন। এবার সেই তেল ফুটিয়ে নিন আগুনে। মিনিট দশেক তেল ফোটাতে থাকুন। একটি কাচের বোতলে সেই তেল ঢেলে রাখুন। সপ্তাহে দুবার করে মাথার তালু ম্যাসাজ করুন
ত্বকের যত্নে যেভাবে ব্যবহার করবেন মেথিশাক
অল্প বয়সেই মুখে বলিরেখা পড়ে যাচ্ছে? ব্রণ আর কালো দাগে ত্বকের স্বাভাবিক সৌন্দর্য ঢাকা পড়ে যাচ্ছে? চিন্তা নেই—মেথি আছে না!
মেথির মধ্যে আছে ত্বক ঠান্ডা রাখার আর ভেতর থেকে পরিষ্কার করার অসাধারণ ক্ষমতা। চাইলে ঘরেই বানিয়ে নিতে পারো একেবারে প্রাকৃতিক একটা ফেসপ্যাক।
একটা ব্লেন্ডারে কয়েকটি তাজা মেথি পাতা, এক চামচ হলুদ, দুধ আর অল্প একটু পানি দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে নাও। তারপর এই প্যাকটা মুখে লাগাও। বিশ মিনিট মতো রেখে, ভেজা তুলো দিয়ে আলতো করে মুখ মুছে ফেলো।
নিয়মিত এই ফেসপ্যাক ব্যবহার করলে বলিরেখা, ব্রণ আর দাগ—সব ধীরে ধীরে কমে যাবে, ত্বকও হবে ঝলমলে আর সতেজ!
কীভাবে খাবেন মেথিশাক
মেথিশাক ভাজা: মেথিশাক রান্নার সময়টা যেন এক টুকরো শান্তি! চলুন, দেখি কীভাবে সহজে সুস্বাদু মেথিশাক ভাজি বানানো যায়। প্রথমে মেথিশাক ভালো করে ধুয়ে কুচি করে নিন। সঙ্গে চাইলে একটু আলু আর কুমড়া ছোট ছোট টুকরো করে কেটে নিন—এই দুটো দিলে শাকের স্বাদ যেন আরও জমে যায়!
এবার কড়াইতে একটু তেল দিন। তেল গরম হলে কালোজিরা আর কাঁচামরিচ কুচি দিয়ে একবার ভালো করে নেড়ে নিন। এরপর দিয়ে দিন কাটা শাক আর তার সঙ্গে লবণ আর হলুদ মেশান। চুলায় মাঝারি আঁচে ভালো করে ভাজুন। শাক থেকে পানি ছাড়বে—ওটা শুকিয়ে এলে ঢাকা দিয়ে দিন। সিদ্ধ হয়ে গেলে নামিয়ে গরম গরম ভাতের সঙ্গে পরিবেশন করুন।
আর যদি আরও সহজে খেতে চান, তবে শুধু পেঁয়াজ, রসুন আর কাঁচামরিচ দিয়েও ভাজি করতে পারেন—স্বাদ একেবারে ঘরের মতো, মা’য়ের রান্নার মতো।
সবজি দিয়ে মেথিশাক: শীতকাল মানেই সবজি-ভরা বাজার। সেই সবজিগুলোকে একসাথে নিয়ে বানিয়ে ফেলুন চমৎকার মেথিশাকের ঘণ্ট—খেতে যেমন সুস্বাদু, তেমনি পুষ্টিতেও ভরপুর। প্রথমেই গাজর, শিম, বেগুন, মটরশুঁটি, ফুলকপি, কুমড়া আর আলু—সব ভালো করে ধুয়ে ছোট ছোট টুকরো করে কেটে রাখুন।
এবার কড়াইতে তেল গরম করে দিন কালোজিরা ফোড়ন। সঙ্গে দিয়ে দিন একটু লবণ আর হলুদ। তারপর একে একে সব সবজি দিয়ে দিন আর হালকা করে ভেজে নিন। কিছুক্ষণ নেড়ে নেড়ে ঢেকে দিন—এতে সবজি তাড়াতাড়ি সেদ্ধ হবে।
সবজিগুলো একটু কষা হয়ে এলে কাঁচামরিচ আর আদা-জিরা বাটা দিয়ে আবার একটু কষিয়ে নিন। সবশেষে দিয়ে দিন মেথিশাক। ভালো করে মিশিয়ে দিন, স্বাদমতো আরেকবার লবণ দেখে নিন।
মেথির পরোটা: প্রথমে একটা বড় বাটিতে নিয়ে নিন আটা। এরপর তার সঙ্গে মেশান তাজা কুচানো মেথিশাক। সঙ্গে দিন এক চিমটি জোয়ান (যেটা হজমেও দারুণ সাহায্য করে), একটু ধনে গুঁড়ো, মরিচের গুঁড়ো আর স্বাদমতো লবণ।
সব উপকরণ ভালোভাবে মিশিয়ে নিন। এবার মাখার সময় একটু সামান্য সাদা তেল দিন, এতে পরোটাগুলো থাকবে নরম আর খেতে হবে আরও বেশি টেস্টি!
ডোটা মেখে নরম করে তৈরি হলে ঢেকে রাখুন প্রায় ৩০ মিনিট, যাতে সব মশলার গন্ধ আর মেথির স্বাদটা ভালোভাবে মিশে যায়। এরপর ছোট ছোট লেচি কেটে, বেলে পরোটার মতো রুটি বানিয়ে একটু তেলে ভেজে নিলেই তৈরি—মেথি পরোটা!