কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি কাদের বেশি?, কিডনিতে পাথর হওয়া একটি খুবই পরিচিত এবং সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা। গবেষণায় দেখা গেছে, ৭০ বছর বয়সী প্রতি ৫ জনে একজন পুরুষ এবং ১০ জনে একজন নারী এই সমস্যায় ভুগতে পারেন। তবে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। কিডনি পাথরের ভালো চিকিৎসা রয়েছে, এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চললে এটি সম্পূর্ণ নিরাময়ও সম্ভব। সবচেয়ে ভালো খবর হলো, কিছু সহজ নিয়মকানুন মেনে চললে বারবার কিডনিতে পাথর হওয়ার সমস্যাও প্রতিরোধ করা যায়।
Table of Contents
কিডনিতে পাথর হয় কেন
প্রস্রাবে কিছু খনিজ উপাদান স্বাভাবিকভাবেই থাকে, যা শরীর থেকে প্রতিদিন বেরিয়ে যায়। কিন্তু কোনো কারণে এই খনিজ উপাদানের পরিমাণ বেড়ে গেলে, তা কিডনি, মূত্রথলি বা মূত্রনালিতে জমা হয়ে ছোট পাথর তৈরি করতে পারে, যা সময়ের সঙ্গে ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। চার মিলিমিটার পর্যন্ত পাথর সাধারণত প্রস্রাবের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে বেরিয়ে যায়। তবে পাথর যদি এর চেয়ে বড় হয় বা কিডনির কোনো জায়গায় আটকে গিয়ে প্রস্রাবের পথ বাধাগ্রস্ত করে, তখন তীব্র ব্যথা, জ্বর, এমনকি বমির মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
পানিশূন্যতা কিডনিতে পাথর হয়
যদি দিনে এক লিটারের কম পানি পান করা হয়, তাহলে প্রস্রাবে খনিজ উপাদানের ঘনত্ব বেড়ে যায়, যা পাথর তৈরি হওয়ার আশঙ্কা বাড়ায়। তাই কিডনির স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে দিনে অন্তত দুই থেকে আড়াই লিটার পানি পান করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
খাদ্যাভ্যাস কিডনিতে পাথর হয়
অক্সালেট–সমৃদ্ধ খাবার যেমন বাদাম, চকলেট, পালংশাক, বিট, এবং চা–কফি বেশি খেলে কিডনিতে পাথর তৈরি হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। সোডিয়াম বা লবণ বেশি খেলে কিডনি দিয়ে অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম বের হয়, যা পাথর তৈরির ঝুঁকি বাড়ায়। এছাড়া, প্রাণিজ আমিষ বেশি খেলে শরীরে ইউরিক অ্যাসিডের পরিমাণ বেড়ে যায়, যা কিডনিতে পাথর তৈরি করতে পারে।
কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি কাদের বেশি?
মায়েরা সব সময়েই বলেন, “বেশি করে জল খা!” কিন্তু সেই কথা ক’জনই বা শুনে? বিশেষ করে যারা অফিসে সারাদিন বসে কাজ করেন, তাঁদের সমস্যা আরও বেশি। সারা দিন বসে কাজ করলে যেমন পেট-কোমরের মেদ বাড়ে, তেমনি শরীরচর্চার অভাব, জল কম খাওয়ার মতো অভ্যাসের কারণে শরীরে নানা রোগ খুব কম বয়সেই বাসা বাঁধে। চিকিৎসকেরা স্পষ্টই বলছেন, কিডনিতে পাথর হওয়ার অন্যতম বড় কারণ হল পানি কম পান করা। তবে শুধু জল কম খাওয়াই নয়, স্থূলতা, বিশেষ কিছু ওষুধ বা সাপ্লিমেন্ট খাওয়া, এমনকি উচ্চ রক্তচাপ থাকলেও কিডনিতে পাথর জমতে পারে।
কিডনি শুধু শরীর থেকে বর্জ্য পদার্থ বের করে নয়, এর দায়িত্ব কিন্তু আরও অনেক। যেমন— রক্তে সোডিয়াম ও পটাশিয়ামের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে কিডনি। হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ঠিক রাখা, শরীরে জলের ভারসাম্য বজায় রাখা, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, রক্তকণিকা তৈরি এবং হাড়ের স্বাস্থ্য ভালো রাখার কাজও কিডনির উপর নির্ভর করে। তবে কিডনিতে পাথর জমলে খুব ভয় পাওয়ার দরকার নেই। কিন্তু সেই পাথর যদি দ্রুত শরীর থেকে বের না হয়, তাহলে সমস্যা বাড়তে পারে। তাই কিডনির যত্ন নেওয়া এবং সচেতন থাকা খুবই জরুরি।
১) দিনে আড়াই থেকে তিন লিটার জল খাচ্ছেন কি? না হলে কিন্তু মুশকিল।
২) যারা বেশি প্রাণিজ প্রোটিন খাচ্ছেন, তাদের ঝুঁকি কিন্তু বেশি। রোজ খুব বেশি তেল-মশলা দিয়ে রান্না করা মাংস, মাছ বা ডিম খাওয়া শুরু করলে বিপদ বাড়তে পারে। এর পাশাপাশি বাইরের খাবার, ফাস্টফুড কিংবা প্রক্রিয়াজাত খাবার বেশি খাওয়ার অভ্যাসও কিডনিতে পাথর জমার ঝুঁকি বাড়ায়।
৩) অতিরিক্ত উদ্বেগ, মানসিক চাপ বা দুশ্চিন্তার কারণে ভ্যাসোপ্রেসিন নামে একটি হরমোন নিঃসৃত হয়। এই হরমোন প্রস্রাবের ঘনত্ব বাড়িয়ে দেয়, যার ফলে কিডনিতে পাথর তৈরি হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। তাই শুধু খাবার নয়, মানসিক স্বাস্থ্যের দিকেও খেয়াল রাখা জরুরি।
৪) যাদের বাতের সমস্যা আছে, তাদের ক্ষেত্রেও কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি বাড়তে পারে। তাই এই বিষয়ে সতর্ক থাকা দরকার।
৫) রক্তে ক্যালসিয়ামের মাত্রা বেড়ে গেলে শরীরের খনিজ উপাদানের ভারসাম্য বিগড়ে যায়, আর তাতে কিডনিতে পাথর হওয়ার আশঙ্কা আরও বাড়ে।
৬) আপনি কি বেশি নুন খান? তাহলে আজ থেকেই সাবধান হন! অতিরিক্ত নুন বা সোডিয়াম খাওয়া প্রস্রাবে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বাড়ায়, যা পাথর তৈরির ঝুঁকি বাড়ায়। তাই খাবারে নুনের পরিমাণ কমিয়ে শরীরকে সুস্থ রাখুন।
কিডনিতে পাথর কি করবেন?
কিডনির যত্ন নিতে কিছু সহজ কিন্তু কার্যকর অভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি। যেমন—
- সোডিয়াম খাওয়া কমান: প্রক্রিয়াজাত খাবার, আচার, এবং ফাস্ট ফুড খাওয়ার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করুন। খাবারের টেবিলে অতিরিক্ত লবণ ব্যবহারের অভ্যাসও সীমিত করতে হবে।
- প্রাণিজ প্রোটিন সীমিত করুন: বেশি মাংস, মাছ বা ডিমের পরিবর্তে উদ্ভিদ-ভিত্তিক প্রোটিন যেমন লেগুম, সয়া ফুড, বাদাম এবং সূর্যমুখী বীজ খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করুন।
- অক্সালেট সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ায় নিয়ন্ত্রণ আনুন: যাদের ক্যালসিয়াম অক্সালেট পাথরের ঝুঁকি বেশি, তাদের পালংশাক, বীট, গমের জীবাণু, এবং চিনাবাদাম খাওয়ার পরিমাণ কমানো ভালো।
- পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম গ্রহণ করুন: ক্যালসিয়াম অক্সালেট এবং ক্যালসিয়াম ফসফেট পাথরের ঝুঁকি কমাতে খাদ্যতালিকায় পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কিডনিতে পাথর কত প্রকার?
কিডনি পাথর বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যা রাসায়নিক গঠনের উপর নির্ভর করে। চলুন, দেখে নেওয়া যাক কোন কোন ধরনের কিডনি পাথর পাওয়া যায়:
- ক্যালসিয়াম অক্সালেট পাথর: এই পাথরটি সবচেয়ে সাধারণ, যা ক্যালসিয়াম এবং অক্সালেটের সংমিশ্রণে তৈরি হয়।
- ক্যালসিয়াম ফসফেট পাথর: এই পাথর ক্যালসিয়াম এবং ফসফেটের মিশ্রণে তৈরি হয়, যা সাধারণত রক্তচাপ এবং ইউরিক অ্যাসিডের ভারসাম্যের পরিবর্তনের কারণে হতে পারে।
- ইউরিক অ্যাসিড পাথর: যখন শরীরে অতিরিক্ত ইউরিক অ্যাসিড জমে, তখন এটি এই ধরনের পাথর তৈরি করতে পারে।
- সিস্টাইন পাথর: সিস্টাইন নামক অ্যামিনো অ্যাসিডের অতিরিক্ত উপস্থিতি কিডনিতে পাথর তৈরি করতে পারে, যা সাধারণত এক ধরনের জেনেটিক পরিস্থিতির কারণে হয়।